মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প

অনুসন্ধানী আইন-আদালত ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ দুর্নীতি প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

♦ বেড়েছে খুনোখুনি ♦ অপরাধ বেড়েছে ১ হাজার ৮০০ শতাংশ! ♦ আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ অপহরণ

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার প্রতিনিধি : কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য। দেশে ইয়াবার চালান প্রবেশ থেকে শুরু করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সবই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কার্যত পরিণত হয়েছে মাদকের গুদামে। সাত বছরের ব্যবধানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮০০ শতাংশ। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্যাম্পে সংঘাত নিত্য ঘটনা। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই হচ্ছে খুন, গুম অপহরণের মতো ঘটনা।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা এবং নানান সীমাবদ্ধতার কারণে চাইলেও তথ্য পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি।’

দক্ষিণ এশিয়ার মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক হুমায়ন কবির খন্দকার। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘনবসতি ও দারিদ্র্য মাদক সংরক্ষণের উপযুক্ত স্থানে পরিণত করেছে। মাদক সিন্ডিকেটগুলো এখন অনেকটা ক্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ক্যাম্প থেকে মাদক পাচারের সিদ্ধান্ত, পাচারের চুক্তি, সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সব কিছুই হচ্ছে। মাদক ব্যবসা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘাতের পরিমাণ বেড়েছে বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রাখাইন স্টেটের রাজধানী ‘সিত্তে’ এবং সর্ব উত্তরের শহরের সীমান্ত শহর ‘মংডু’। মায়ু পর্বতমালা এবং নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ সাগর পথে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশের পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চালান চলে যায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। মাদকের চালান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশের পর তা চলে যায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থি সংগঠনের নেতাদের হাতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এমন চারটি উগ্রপন্থি সংগঠন ছাড়াও রয়েছে অর্ধশতাধিক সংগঠন। তাদের মধ্যে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে একের পর এক সংঘাত হচ্ছে। মাদকের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। শুধু ২০২৩ সালে ১৪৪ রোহিঙ্গাকে মাদকসহ গ্রেফতার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চল। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১৩০টি মামলা। তাদের কাছ থেকে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৩৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। সাত বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ইয়াবাসহ ৭ শতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে ৬৪০টি মামলা দায়ের করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৬০ পিস ইয়াবা। একই সময়ে পুলিশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩ হাজার ২০০ জনের বিরুদ্ধে মাদক মামলা দায়ের করে পুলিশ। সাত বছরে দায়ের হওয়া মাদকের মামলা সংখ্যা ২ হাজার ২০০। পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৮৪০টি। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৩ হাজার ৯০০। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের ভয়াবহতার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদকের মামলা হয়েছিল মাত্র ৩৫টি। সাত বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ বছরে মাদক-সংশ্লিষ্ট মামলা বছরে বেড়েছে হয়েছে ৬৩০টি। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮০০ শতাংশ। ২০২২ সালে ১৪৭ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ১৫২৪ জনকে। ২০২১ সালে ৬০৫ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ৬৩০ রোহিঙ্গাকে। ২০২০ সালে ৫৩৮ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ৫৩২ জনকে। ২০১৯ সালে ১৭৮টি মাদক মামলায় আসামি করা হয় ২৭৪ জনকে। ২০১৮ সালে ১২৪টি মাদক মামলায় আসামি করা হয় ১৯০ জনকে। ২০১৭ সালে ৩৫টি মামলায় আসামি করা হয় ৫৩ জনকে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে যে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। তাই ধারণা করছি, মাদক চেইন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে।’ কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেই হচ্ছে। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে।’

আরো পড়ুন : গভীর সংকট তৈরি হয়েছে পোশাক খাতে

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *