ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন–ভাতা আদায়ে আরও দুই শ্রমিকনেতাকে নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডে গিয়েছিলেন শহিদুল ইসলাম।
মালিকপক্ষের সঙ্গে বসলেও বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় পরদিন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মালিকপক্ষ। কারখানা থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরেই তাঁদের ওপর হামলা করা হয়, যাতে প্রাণ হারান শহিদুল।
গত ২৫ জুন রাতে টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকায় কারখানাটির কাছে ওই হামলার শিকার অপর দুই শ্রমিকনেতা এ তথ্য দেন। তাঁদের মধ্যে মো. মোস্তফা বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী পরিষদের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি। আর মো. শরীফ জাতীয় নিট ডাইং গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক।
নিহত শহিদুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি। ১১ বছর আগে এই সংগঠনেরই নেতা আমিনুল ইসলাম খুন হয়েছিলেন। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হওয়ার পরদিন তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানা এলাকায়।
আরও পড়ুন: টঙ্গীতে শ্রমিকনেতা শহিদুল হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তারে গড়িমসি করছে পুলিশ
শ্রমিকদের পক্ষে ভূমিকা রাখায় আমিনুলের মতো শহিদুলকেও প্রাণ দিতে হলো বলে মন্তব্য করেছেন তাঁদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কল্পনা আক্তার। তিনি বাদী হয়ে শহিদুল হত্যার ঘটনায় ২৬ জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন। তাতে আসামি হিসেবে যে ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের পাঁচজনই আরেকটি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন নামে ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষের হয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। কল্পনা আক্তার অভিযোগ করেন, ওই হামলাকারীরা মালিকপক্ষের ভাড়াটে সন্ত্রাসী। তাঁরা শ্রমিকনেতা পরিচয় দিয়ে হোক, গুন্ডা পরিচয় দিয়ে হোক, যা-ই হোক না কেন, মালিকপক্ষের হয়ে হামলা চালিয়েছেন।
মামলার প্রধান আসামি মো. মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক। অপর আসামিদের মধ্যে আকাশ আহমেদ একই সংগঠনের গাজীপুর জেলার সহসভাপতি। রিপন ওই শ্রমিক সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক। সোহেল ও রাসেল এই সংগঠনেরই কর্মী।
এই পাঁচজনকে হামলাকারী বলে অভিযোগ করেছেন শহিদুলের সঙ্গে হামলার শিকার শ্রমিকনেতা মোস্তফা ও শরীফ। আসামিদের মধ্যে কেবল মাজাহারুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কল্পনা আক্তার বলেন, আসামিরা এলাকার পরিচিত মুখ হলেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করছে না।
মালিকের পক্ষে ওসির সাফাই
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বকেয়া বেতনের বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্থতা করতে যাওয়া শহিদুলসহ তিন শ্রমিকনেতার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেন ‘হানিফ ম্যানেজার’ নামের এক ব্যক্তি। তিনি স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী কামরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। কামরুলের কাছ থেকে কেনা জমিতেই পোশাক কারখানাটি করেছেন মো. সাইফ উদ্দিন। কামরুলের ভাই আমির হোসেন ওই কারখানার ঝুট কিনে বাইরে বিক্রি করেন। শহিদুল হত্যা মামলায় কারখানার মালিক সাইফ উদ্দিন ও কামরুলের নাম নেই।
কামরুল ইসলাম স্থানীয়ভাবে ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত। তিনি এলাকায় ঝুটের ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। কল্পনা আক্তারের অভিযোগ, ওই দিন কামরুলের নির্দেশেই তাঁর ‘ম্যানেজার’ হানিফ নেতৃত্ব দিয়ে শহিদুলের ওপর হামলা চালান।
তবে কামরুল ইসলাম বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। হানিফ নামে তিনি কাউকে চেনেন না বলেও দাবি করেন।
শহিদুলের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করেছে, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও তাঁর সহকর্মীদের দেওয়া তথ্যমতে, বেতন–ভাতার দ্বন্দ্বের জেরে প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডের মালিকপক্ষ ও শহিদুল এবং তাঁর সহকর্মীদের কথা–কাটাকাটি ও মারামারি লেগে যায়। মারামারির একপর্যায়ে শহিদুল মাটিতে শুয়ে পড়েন। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে শহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় মালিকপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, এমন তথ্য উঠে এলেও মামলায় তাঁদের কারও নাম নেই।
এ বিষয়ে মামলার বাদী কল্পনা আক্তার বলেন, টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি শাহ আলম মালিকপক্ষ এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তি কামরুলকে আসামি করার বিষয়ে আপত্তি তোলেন। ওসি বলেছিলেন, কারখানার নাম আছে। তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে স্বাভাবিকভাবে তাঁরা আসামি হবেন।
কারখানার মালিক মো. সাইফ উদ্দিন গত রাতে মুঠোফোনে বলেন, শহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর কারখানার কেউ জড়িত নন। এটা গাজীপুরের এক সংগঠনের সঙ্গে অন্য সংগঠনের দ্বন্দ্বের জেরে হতে পারে।
এদিকে পুলিশও কারখানার মালিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী কামরুলের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি শাহ আলম বলেন, ঘটনার সময় মালিকপক্ষের কেউ ছিলেন না। আর হানিফের সঙ্গে কামরুলের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ঘটনার পেছনে শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলই দায়ী বলে তিনি মনে করেন। কারণ, মামলার বাদী এবং প্রধান আসামি দুজনই আলাদা দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতা।
তবে কল্পনা আক্তার বলেছেন, মালিকপক্ষের যোগসাজশেই শহিদুলের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ সেদিকে নজরই দিচ্ছে না।
আরো পড়ুন : কবি আফতাব আহমদ আর নেই