মূল্যস্ফীতির চাপে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ

অর্থনীতি জনদুর্ভোগ জাতীয় প্রচ্ছদ মুক্তমত লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। বাজারে চাল, ডাল, তেল, ব্রয়লার মুরগি, চিনি, লবণ, আটা-ময়দা-সব পণ্যই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি মাছ-মাংস, আলু, পিয়াজ ও ডিমের দাম লাগামছাড়া। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকেও একই চিত্র দেখা গেছে।

মূল্যস্ফীতির চাপে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই সঞ্চয় করা তহবিল ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাচ্ছেন। গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২.৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন খাদ্যপণ্যের দাম কমার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে আমি কখনোই এত বড় অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি। তিনি মনে করেন পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই।

জাতীয় নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। গত সোমবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ওদিকে অস্বাভাবিক বাজারদরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অধিকাংশ মানুষ। সামাজিক মাধ্যমেও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে ব্যঙ্গ করছেন অনেকেই।
মূল্যস্ফীতি হলো একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়েছে। এখন বাজারে সবধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া।

বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহও স্বাভাবিক। এরপরও নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য এক বা একাধিক পণ্য টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রতিকেজি আলুর দাম ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু বাজারে এই দাম কার্যকর হয়নি। প্রতিকেজি ৬০-৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে ৭০ টাকাও বিক্রি করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চে পিয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ১০০-১১০ টাকা বিক্রি করে। কারসাজি রোধে ১৪ই সেপ্টেম্বর কিছুটা মূল্য কমিয়ে প্রতিকেজি দেশি পিয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায়। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিপিস ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে হয় ১১ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিপিস ডিমের দাম ১৬ টাকাও বিক্রি হয়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে ১৪ই সেপ্টেম্বর প্রতিপিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তারপরও খুচরা বাজারে প্রতিপিস ১৩-১৪ টাকায় বিক্রি হয়। মূল্য নিয়ন্ত্রণে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই আমদানি করা ডিম দেশেও এসেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতিপিস ডিম কিনতে ক্রেতা ১৩ টাকা খরচ হচ্ছে। এদিকে কেজিপ্রতি চিনি জুনে ১৪০ টাকা বিক্রি হয়। যদিও সরকার কেজিপ্রতি চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৩০ টাকা। কিন্তু সেই দামও মানা হচ্ছে না।

একটি পোশাক কারখানায় ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন সাইফুল ইসলাম। মাসে মোট বেতন ৪০ হাজার টাকার মতো। দুই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীসহ চারজনের সংসার। তিনি বলেন, যেদিন বেতন হয়, সেদিনই টাকা নাই হয়ে যায়। বিভিন্ন বাকি বকেয়া আর বাসাভাড়া পরিশোধেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়। মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বন্ধই বলা চলে। এরপর সন্তানের স্কুলের বেতন দেয়ার পর হাতে তেমন কিছু থাকে না। ধার করতে হয় অন্য সব খরচ চালাতে। সাইফুলের মতো অবস্থা হয়তো প্রায় সব সীমিত আয় ও নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের।

লম্বা সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, তা দেখা যাচ্ছে সরকারের পরিসংখ্যানেই। বিবিএস বলছে, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় সমান। গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৩ শতাংশ। শহরে এই হার কিছুটা বেড়ে ১২.৫৮ শতাংশ। অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্যে দেখা গেছে, সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৯৩ শতাংশ। আগের মাসে এই হার ছিল ৯.৬৩ শতাংশ। এ বছর মার্চ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর আছে।

টিসিবি’র তথ্যে দেখা গেছে, গত বছর নভেম্বরে দেশি পিয়াজের কেজি ছিল ৬০ টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরে এই পিয়াজের কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে রসুনের কেজি ছিল ৯০ টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরে এই রসুনের কেজি ২২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আদার কেজি ছিল ২৪০ টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরে এই আদার কেজি ৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর নভেম্বরে চিনির কেজি ছিল ১১৫ টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরে এই চিনির কেজি ১৪০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া গত বছর নভেম্বরে আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরে এই আলুর কেজি ৫০ টাকার উপরে দাঁড়িয়েছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো ঠেকাতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সম্প্রতি পিয়াজ ও কাঁচামরিচের মূল্যবৃদ্ধি এর উদাহরণ। গত এক বছরে বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। কিন্তু শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে।

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে গিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে না জনসাধারণ। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বাজার পরিস্থিতি বলছে, মোটা চালের কেজি ৫৫-৫৬ টাকা, মসুরের ডাল ১৩৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা কেজি দরে। পাঙ্গাশ বিক্রি হয়েছে ১৯০ থেকে ২২০ টাকায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন হলো- গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষ খাবে কী?

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে আয় না বাড়লেও সব শ্রেণির মানুষের ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর করছেন না। এমনকি অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে। তিনি বলেন, সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকিতে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের সমন্বিত তদারকির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেন, পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে হচ্ছে সিন্ডিকেট। সেজন্য অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সেগুলোর দামও বাড়ছে। সেজন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে ডলারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।

যারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে তাদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত শুক্রবার তিনি এই নির্দেশ দিলেও অসাধুদের ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বাজার তদারকিতে ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেছে।

আরো পড়ুন : ৮ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার নামাজের সময়সূচি

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *