মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় পেয়েছিলেন

আইন-আদালত আন্তর্জাতিক ওকে নিউজ স্পেশাল প্রচ্ছদ হ্যালোআড্ডা

পুলিশের হেফাজতে এক কুর্দি তরুণীর মৃত্যুর প্রতিবাদে ইরানে চার মাস আগে শুরু হওয়া বিক্ষোভের জেরে সম্প্রতি চার তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আরও ১৮ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ভুয়া বিচারের মাধ্যমে অন্যায্যভাবে তাঁদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

৭ জানুয়ারি মোহাম্মদ মেহদি কারামি নামে ২২ বছর বয়সী এক তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মাত্র ৬৫ দিন আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। বিবিসি ফারসিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় পেয়েছিলেন কারামি।

তাঁর এই ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, কীভাবে ইরানি কর্তৃপক্ষ লোক দেখানো বিচারের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা—যে বিক্ষোভকারীরা ইরানের ধর্মীয় অনুশাসনের অবসান এবং স্বাধীনতার দাবিতে পথে নেমেছেন।

‘মাকে কিছু বোলো না’

ইরানে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল দেশটির নীতি পুলিশের (ইরানে ধর্মীয় বিধিবিধান মানা হচ্ছে কি না, তা নজরদারির দায়িত্বপ্রাপ্ত) হেফাজতে মাসা আমিনি (২২) নামে তরুণীর মৃত্যুর পর। ‘যথাযথভাবে’ হিজাব না পরার কারণে গত সেপ্টেম্বরে নীতি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের তিন দিন পর মাসা আমিনির মৃত্যু হয়।

বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ইরানের সরকার একে দাঙ্গা ও বিদেশি মদদপুষ্ট বলে দাবি করে। এসব অভিযোগ তুলে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে সহিংস পন্থায় বিক্ষোভ দমনের অভিযান শুরু করে সরকার। নরওয়েভিত্তিক সংস্থা ইরান হিউম্যান রাইটসের হিসাবে, ইরানে অন্তত ৪৮১ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে।

ইরানের আধাসামরিক বাহিনী বাসিজের একজন সদস্যকে হত্যার অভিযোগে কারামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, গত ৩ নভেম্বর রাজধানী তেহরানের অদূরে কারাজ শহরে বিক্ষোভ চলছিল। ওই দিন বাসিজ বাহিনীর এক সদস্যকে হত্যা করেন বিক্ষোভকারীরা। সেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কারামি।

কারামিকে গ্রেপ্তারের পর ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে শত্রুতার’ মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। এরপর বিচারের জন্য গত ৩০ নভেম্বর কারাজ শহরে ইরানের বিপ্লবী আদালতে কারামিসহ ১৬ জনকে তোলা হয়। এদিন আদালতে তোলা ১৬ জনের মধ্যে তিনজন শিশু। তাদের বিরুদ্ধে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।

ইরানে আসামিদের মামলায় লড়তে আইনজীবী নিয়োগের অধিকার আছে। কিন্তু কারামির এই মামলার মতো সংবেদনশীল মামলা কিংবা গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় আসামিদের আইনজীবী নিয়োগ করার সুযোগ নেই। পরিবর্তে বিচার বিভাগ অনুমোদিত তালিকা থেকে আদালত আইনজীবী নিয়োগ দেন।

সাংবাদিক ও আসামির পরিবারের সদস্যরা আদালতে ঢুকতে পারেন না। এর মানে, জিজ্ঞাসাবাদে জোরপূর্বক দায় স্বীকার করিয়ে নেওয়া পর রুদ্ধদ্বার আদালতে বিচারের মাধ্যমে একজন আসামির মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি জানার একমাত্র উপায় সে সময়কার সম্পাদিত ভিডিও ফুটেজ, যেটা রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হয়।

এমন একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কারামি বাসিজ বাহিনীর ওই সদস্যের মাথায় পাথর ছোড়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ সময় তাঁকে খুব বিপর্যস্ত দেখায়। আদালতের নিয়োগ দেওয়া তাঁর আইনজীবী এ বিষয় নিয়ে চ্যালেঞ্জ বা আপত্তি তুলছেন না। এর পরিবর্তে তিনি কারামিকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য বিচারকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। দায় স্বীকার ও আদালতের নিয়োগ করা আইনজীবীর এমন আচরণের পর কারামি বুঝতে পারেন, তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে। এরপর তিনি বসে পড়েন।

ইরানের বিচার বিভাগ থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ ডিসেম্বরে বিপ্লবী আদালত কারামিকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে একই মামলার আরও চার আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। একই মামলার আরও আটজন আসামির দীর্ঘ মেয়াদে সাজার রায় দেন আদালত।

বিচারকাজ ও রায় নিয়ে চুপ থাকার জন্য সাধারণত আসামির পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে থাকে সরকারি কর্তৃপক্ষ। তবে কারামির বাবা ইতেমাদ নামে একটি সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকারে বলেন, যেদিন মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়, সেদিন তাঁর ছেলে তাঁকে ফোন দিয়ে কেঁদেছিল। কারামির বাবা রাস্তায় টিস্যুর প্যাকেট বিক্রি করেন।

তাঁর ছেলে নির্দোষ, তা পুনরায় দাবি করে কারামির বাবা জানান, সেদিন তাঁর ছেলে বলেছিল, ‘বাবা, তারা রায় দিয়েছে। আমার মৃত্যুদণ্ড। মাকে কিছু বোলো না।’

কারাগারে ভয়ংকর নির্যাতন

পরে ১৫০০ তাসভির নামে অধিকারকর্মীদের একটি প্ল্যাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ তোলে, গ্রেপ্তারের পর কারামির ওপর নির্যাতন চালানো হয়।

আরও বলা হয়, কারাগারে দেখা করতে গেলে কারামি তাঁর পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে এমনভাবে মারধর করেন যে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। নিরাপত্তারক্ষীরা মনে করেছিলেন তিনি মারা গেছেন। তাই তাঁর দেহ দূরে এক জায়গায় ফেলে দেন। তবে ফেরার সময় তাঁদের মনে হয় কারামি জীবিত আছেন।

অধিকারকর্মীদের সেই প্ল্যাটফর্মটির অভিযোগ, কারামি তাঁর পরিবারের সদস্যদের আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে নানাভাবে নির্যাতন করতেন। এর মধ্যে একটি হলো, জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রতিদিন নিরাপত্তারক্ষী তাঁর পুরুষাঙ্গে হাত দিতেন এবং একই সঙ্গে তাঁকে বলাৎকারের হুমকি দেওয়া হতো।

ইরানের বিচারব্যবস্থা বা আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালত যখন কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন, তখন তাতে অনুমোদন নেওয়ার জন্য সেই রায়ের অনুলিপি দেশটির সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। সুপ্রিম কোর্ট যদি নিম্ন আদালতে দেওয়া কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন, তার বিরুদ্ধেও আপিল করার সুযোগ আছে।

কারামির বাবা সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিয়োগ করা আইনজীবীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাননি। পরে তাঁরা ইরানের সবচেয়ে পরিচিত মানবাধিকার আইনজীবীদের একজন মোহাম্মদ হোসেইন আগাসিকে নিয়োগ দেন।

হোসেইন আগাসি বলেন, ‘কারামি কারাগার থেকে তিনবার আমাকে ফোন করে তাঁর মামলা লড়তে বলেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে আহ্বান জানানো হয়।’

কারামির হয়ে মামলা লড়তে হোসেইন আগাসি প্রথমে নিম্ন আদালত এবং পরে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর আবেদন উপেক্ষিত, নয়তো প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ ছাড়া কারামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও এক বিচারক সেই আপিল বাতিল করে দেন।

ইরানের সরকারি কর্তৃপক্ষ বারবার এ কথা বলে আসছে যে বিক্ষোভকারীদের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তি প্রদান একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে বোঝানো হয়েছে।

নির্যাতনের আরও চিত্র

সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেইনি। বয়স ৩৯ বছর। তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী। শিশুদের কোচিং করান। কারামির সঙ্গে গত ৭ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারামির মামলায়ই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।

হোসেইনির বাবা–মা কেউ জীবিত নেই। তাই আদালতে হোসেইনির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর দণ্ড পাওয়া অন্য আসামির পরিবারের নেতৃত্ব যেভাবে রায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়েছে, তাঁর ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। তবে ‘আমরা সবাই মোহাম্মদের পরিবার’—এমন পোস্ট শেয়ার করেন ইরানের অনেকে।

নিম্ন আদালতে হোসেইনির মৃত্যুদণ্ডের রায় সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখার পর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হোসেইনি অবশ্য তাঁর হয়ে মামলা লড়তে একজন আইনজীবী নিয়োগ করতে সমর্থ হন। গত বছরের ডিসেম্বরে আইনজীবী আলী শরিফজাদে আরদাকানি কারাগারে হোসেইনির সঙ্গে দেখা করেন ও পরে এ নিয়ে টুইট করেন।

টুইটে আলী শরিফজাদে বলেন, ‘আমার সঙ্গে দেখা করার পুরোটা সময়ই সে (হোসেইনি) কেঁদেছে। সে তার ওপর সংঘটিত নির্যাতনের বিষয়ে জানায়। চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে মারধর, মাথায় লাথি ও অজ্ঞান হওয়ার ঘটনার কথা বলে। নির্যাতন করে তাঁর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আইনত এর কোনো ভিত্তি নেই।’

হোসেইনির পক্ষে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন আইনজীবী আলী শরিফজাদে। আপিলের পর এই আইনজীবীকে ৭ জানুয়ারি আদালতে হাজির হতে বলা হয়। তবে সেদিন আদালতে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর জানতে পারেন, তাঁর মক্কেল হোসেইনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

এ ঘটনার পরই আইনজীবী আলী শরিফজাদেকে গ্রেপ্তার করে সরকারি কর্তৃপক্ষ। তবে বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। একটি সূত্র বিবিসি ফারসিকে জানিয়েছেন, টুইটে কারাগারে তাঁর মক্কেল হোসেইনিকে নির্যাতনের অভিযোগ তোলায় আলী শরিফজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন কারাজের একজন সরকারি কৌঁসুলি।

মৃত্যুদণ্ডের মুখে আরও শতাধিক বিক্ষোভকারী

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ‘জোরপূর্বক জবানবন্দি নেওয়া’ অর্থাৎ দায় স্বীকারে বাধ্য করার এসব ঘটনায় ইরানের বিচারব্যবস্থার নিন্দা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। একটি সূত্র বিবিসিকে বলছেন, আসামির পক্ষ নিয়ে কথা বলার পরিবর্তে রাষ্ট্রের নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীরাই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দি দিতে চাপ দেন।

ইরান হিউম্যান রাইটসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ১০৯ জন বিক্ষোভকারী ফাঁসিতে ঝোলার মুখে আছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে অথবা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে—এমন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভকারীদের ৬০ জনের গড় বয়স ২৭ বছর। ১৮ বছরের কম বয়সের আছেন তিনজন।

কারামি ও হোসেইনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ইরান কর্তৃপক্ষের প্রতি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

কিন্তু এর এক সপ্তাহ পরে দেশটিতে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব থাকা ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলী রেজা আকবারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যুক্তরাজ্যের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে এর আগে ইরানের একটি আদালত আলী রেজার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন।

গত সপ্তাহে বিবিসি একটি অডিও রেকর্ড পেয়েছে। সেখানে আলী রেজাকে বলতে শোনা যায়, যে অপরাধ তিনি করেননি, নির্যাতন চালিয়ে তাঁর কাছ থেকে সেই অপরাধের দায় স্বীকারে বাধ্য করা হয়। ইরানে শুধু বিক্ষোভকারীই নন, সরকারবিরোধী মত দমনে লোক দেখানো বিচারের নামে যেকোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বিবিসি থেকে ভাষান্তর: আল–আমিন সজীব

আরো পড়ুন : ‘বাংলাবিদ’, এর পঞ্চম আসরের প্রথম অডিশন আগামী ২০ জানুয়ারি

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *