ঢাকার ধানমন্ডিতে সকালে স্বামীর সঙ্গে রিকশায় থাকা অবস্থায় মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে একজন নারী উদ্যোক্তা নিহত হয়েছেন। নিহত সৈয়দ আমিনা হক (৫৮) একটি বুটিক হাউস চালাতেন। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাধারণ পরিষদের সদস্য এবং বাংলাদেশ বুটিক হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
ঘটনা ঘটে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ধানমন্ডির সাত মসজিদ সড়কে। স্বজনেরা জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে যোগব্যায়াম করতে যান আমিনা হক। সেখান থেকে রিকশায় চড়ে স্বামী–স্ত্রী বাসায় ফিরছিলেন। রিকশাটি যখন তাঁদের বাসার কাছে পৌঁছায় এ সময় পেছন থেকে মোটরসাইকেল আরোহী দুই ছিনতাইকারী আমিনার হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেন। তখন রিকশা থেকে পড়ে গুরুতর জখম হন আমিনা হক। তাঁর বুকের পাজরের পাঁচটি হাড় ভেঙে যায়। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শ্যামলীর ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমিনা হক মারা যান।
এ ঘটনার তিন দিন পর আমিনা হকের ছেলে আহমেদ ওমর নাঈম বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন। এর দুই দিনের মাথায় ঘটনায় জড়িত অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডি থানা-পুলিশ। তাঁরা হলেন আদাবরের বাসিন্দা মো. স্বপন সরকার (৫১) ও তাঁর শ্যালক সাব্বির (২৪)। দুজনই আমিনা হকের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ধানমন্ডির যে স্থানে দুর্বৃত্তরা সৈয়দা আমিনা হকের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেন সে এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। পরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সহায়তায় আদাবরের শেখেরটেক থেকে স্বপন ও তাঁর শ্যালক সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুদিদোকানির আড়ালে পেশাদার ছিনতাইকারী
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, স্বপন সরকার ও সাব্বির লাল রঙের একটি মোটরসাইকেলে এসে আমিনা হকের ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন স্বপন। তাঁর পেছনে বসা সাব্বির রিকশায় থাকা আমিনার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেন। আদাবরে স্বপনের বাসার নিচ থেকে ওই মোটরসাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ।
তদন্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, আদাবরে স্বপন সরকারের একটি মুদিদোকান রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি শ্যালক সাব্বিরকে নিয়ে ছিনতাই করে আসছিলেন। সেদিনও সকালবেলা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। ধানমন্ডিতে এসে আমিনা হকের কাছে ভ্যানিটি ব্যাগ দেখে সেটি ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা।
মামলার বাদী ও আমিনা হকের ছোট ছেলে আহমেদ ওমর নাঈম বলেন, তাঁর মা–বাবা সপ্তাহে দুই দিন ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে যোগব্যায়াম করতে যেতেন। সেদিন যোগব্যায়াম শেষে দুজনে রিকশায় করে ফিরছিলেন। বাসার সামনে পৌঁছানোর পরই ঘটনাটি ঘটে। পেছন থেকে দ্রুতগতিতে এসে একজন মোটরসাইকেল আরোহী মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিলে তিনি নিচে পড়ে যান। তবে মায়ের কাছ থেকে ব্যাগটি তাঁরা ছিনিয়ে নিতে পারেননি।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেদিন আমিনা হক নিচে পড়ে গেলে স্থানীয় লোকজন চিৎকার দেন। তখন স্বপ্ন ও সাব্বির দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যান। পরে তাঁরা আর সেদিন বাসায় থাকেননি।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, স্বপন সরকার প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকা শহরে ছিনতাই করে আসছেন। পাঁচ বছর আগে ছিনতাই করার সময় গুলিবিদ্ধ হন স্বপন। তখনো তিনি ধানমন্ডি থানায় কর্মরত ছিলেন। এবার গ্রেপ্তারের পর স্বপন সরকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন, জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি আবার আগের মতো ছিনতাই করে আসছিলেন।
বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ সৈয়দা আমিনা হকের দুই ছেলে লেখাপড়া শেষ করেছেন। এক সপ্তাহ আগে তাঁর বড় ছেলের বাগ্দান হয়েছে। খুব শিগগির বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান করে ছেলের বউকে ঘরে আনার পরিকল্পনা ছিল আমিনা হক ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ দম্পতির।
আমিনা হকের ছেলে আহমেদ ওমর নাঈম বলেন, ‘মায়ের স্বপ্ন ছিল, বড় ভাইয়ের বউকে ঘরে আনবেন। কিন্তু মায়ের সেই স্বপ্ন আর কোনো দিন পূরণ হবে না। দিনের বেলা ধানমন্ডির মতো জায়গায় মাকে মেরেই ফেলল ছিনতাইকারীরা।’ মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
ঢাকায় ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তাতে ঘাটতির কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান। আমিনা হকের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির কারণে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা এসব অপকর্ম করতে পারছে। তাদের হাতে অনেকে নির্মম মৃত্যুর শিকারও হচ্ছেন।