সরকার দেশের অভ্যন্তরে নাগরিকদের অবস্থান শনাক্তে নয়া প্রযুক্তি চালু করতে যাচ্ছে। যেটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করবে। রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কার্যক্রম রোধে শিগগিরই কঠোর এই নজরদারি সিস্টেম কার্যকর হবে। নতুন এই প্রযুক্তির নাম- ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম বা সমন্বিত আইনসম্মত আড়িপাতা পদ্ধতি। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে। যেটি মানুষের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং বাংলাদেশকে একটি কঠোর নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত করবে। একই সঙ্গে আদালতের অনুমতি ব্যতীত এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলে তা রাষ্ট্রীয় আইনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে।
নতুন প্রযুক্তি চালু হলে অপারেটরদের সহায়তা নিয়ে কিংবা সহায়তা ছাড়াই নির্ধারিত সার্ভারে প্রবেশ করে সন্দেহভাজন ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ পদ্ধতিতে মোবাইল ফোন অপারেটর ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এবং ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জের (এনআইএক্স) মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারি সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। প্রয়োজনবোধে একই সঙ্গে অনেক মানুষের গতিবিধিও নজরদারি করা যাবে। ফ্রান্সের একটি কোম্পানি থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণও কেনা হয়েছে।
এ ছাড়াও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে টেলিকম অপারেটরদের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত প্রত্যেকটি মোবাইল ফোনের আইএমইআই নাম্বারকেই নজরদারির এই সিস্টেমে সংযুক্ত করে দেয়া হবে। একই সঙ্গে ওই মোবাইলে থাকা সবগুলো সিমকে ট্র্যাক করা হবে। আগে এসব ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত করতে কাছাকাছি কয়েকটি টাওয়ারের সিগন্যাল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করতো সরকারি সংস্থাগুলো। সেক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছাকাছি অবস্থান শনাক্ত করা গেলেও সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করা যেতো না। কিন্তু নতুন প্রযুক্তিতে একটি ট্রায়াংগুলেশন মেথড ব্যবহার করে বিভিন্ন উপকরণের সহায়তায় ওই মোবাইল ফোনটির সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা যাবে।
২০২১ সালে আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয় সরকার ইসরাইল থেকে নজরদারি প্রযুক্তি কিনেছে। গত বছর ইসরাইলি সংবাদ মাধ্যম ‘হারেৎজ’ বাংলাদেশের কাছে ইসরাইলের গোয়েন্দা নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করার খবর প্রকাশ করে। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে, আধা কিলোমিটার পরিধিতে থাকা সব ডিভাইসে হোয়াটসঅ্যাপের এনক্রিপ্টেড বার্তা, ফেসবুকের চ্যাট, কন্টাক্ট লিস্ট, কল এবং বার্তায় প্রবেশ করা যায়।
চলতি বছর ১২ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ইন্টারনেটে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নজরদারি করতে সরকার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ ছাড়াও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম রহিতকল্পে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে ওপেন সোর্স ইনটেলিজেন্ট টেকনোলজির মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে এবং একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মোবাইল ফোনে আড়িপাতার এ প্রযুক্তি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশে সংবিধান ও আইনের তোয়াক্কা করা হয় না। কিংবা আমরা আইন বুঝি না। আমাদের আইনে বাসস্থানের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়টি আছে। কাউকে সন্দেহ হলে সরকার আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে মোবাইল ফোনে আড়িপাততে পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের কাজ করতে হলে আগে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আদালতকে বুঝাতে হবে কেন ওই ব্যক্তির ওপর নজরদারি দরকার। তার স্বপক্ষে প্রমাণাদি দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ধারণা নাই। সরকার করতে চাইছে, করবে। তিনি বলেন, এ নজরদারির সঙ্গে মৌলিক অধিকারের বিষয়টি জড়িত। প্রত্যেক ক্ষেত্রে আদালতকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন ওই ব্যক্তির ওপর নজরদারি করবেন তারা। এই আইনজীবী মনে করেন, নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে নতুন সিস্টেমটি মিসইউজ হতে পারে। তিনি বলেন, সরকার নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। ভয়ভীতি তৈরি করতে চায়। তাই এ ধরনের নজরদারি চালু করতে চাইছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেটি কখনো সম্ভব না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মোবাইলে আড়িপাতা নতুন কিছু নয়। এটা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। নতুন পদ্ধতি তার ধারাবাহিকতায় আরও কঠোর হচ্ছে। নজরদারির পদক্ষেপ বিবেচনা করলে দেখা যায় এটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অন্তরায়। এর অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। একই সঙ্গে বোঝা যায় বাংলাদেশ কঠোর নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। এটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক হয়রানির ক্ষেত্রেও অপব্যবহার হতে পারে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, সবার উপরে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র চাইলে তার নিরাপত্তার জন্য যেকোনো ধরনের আড়িপাততে পারে, এটা বৈধ। রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্রের উপাদানেও এটি নিয়ে সঠিক আইন রয়েছে। এটি অশনি সংকেত হতে পারে রাষ্ট্রবিরোধীদের জন্য। সে ক্ষেত্রে এটা পজেটিভ। একই সঙ্গে বিরোধীদের দমন বা হয়রানির বিষয়টিও সামনে চলে আসে। তবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা হয় কিনা- সেটা সামনে বুঝা যাবে। আবার হিউম্যান এররের জায়গা থেকেও কিছু কিছু জায়গায় এটি মিসইউজ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।