মোহাম্মদপুরে প্রকাশ্যে গণছিনতাই হলো সন্ধ্যা ৭টায়, পুলিশ আসল রাত ১২টায়

অনুসন্ধানী ইভটিজিং ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ নারী নারী নির্যাতন পুরুষ পুরুষ নির্যাতন প্রচ্ছদ লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা নিত্যদিনের। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যার ঘটনাটি একেবারেই ব্যতিক্রম। এদিন গণহারে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। দলবদ্ধ ছিনতাইকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রকাশ্যে একের পর এক ছিনতাই করেছে। সামনে যাদের পেয়েছে তাদের কুপিয়ে সঙ্গে থাকা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। শুধু পথচারীই নয়, আশপাশের দোকানে প্রবেশ করে ক্যাশের টাকা, মালপত্র ছিনতাই করেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে পুরো এলাকায়। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বসিলা ৪০ ফিট এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে গার্ডেন সিটি হয়ে ওয়াকওয়ের চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জনের ছিনতাইকারী দল। জনসম্মুখে রাস্তায় যাকে পেয়েছে তার কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। দোকানের ক্যাশবাক্স লুট করা হয়েছে।

তাদের হাতে থাকা অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন নিরীহ মানুষ। মহিলা, বৃদ্ধরাও ছাড় পায়নি তাদের হাত থেকে। ঘটনার একদিন পরও ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী তাদের দোকান বন্ধ রাখেন। স্থানীয়রা বলছেন, হরহামেশা এলাকাটিতে ছোটখাটো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে, তবে শুক্রবারের ঘটনাটি ছিল নজিরবিহীন।

এলাকাটিতে চলমান একটি প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত জাহিদুল ইসলাম, শামীমুল ইসলাম ও মো. আব্দুল আজিজ নামে তিন ব্যক্তিও ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ভুক্তভোগী জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাড়ি শেরপুর জেলায়। কিছুদিন হলো ঢাকায় এসেছি। শুক্রবার সন্ধ্যায় আমি ডিউটি শেষ করে বাসার নিচে আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম। আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন শামীম ও আজিজ। হটাৎ ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল আমাদের দিকে দৌঁড়ে আসে। সকলেই টিন এজার। আমরা কিছু বুঝতে না পেরে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একটা ছেলে এসে আমার ফোন টান দিয়ে নিয়ে যায়। পরে চাপাতি দিয়ে মাথায় কোপ দেয়। আর কয়েকজন এসে শামীম ও আজিজকে জাপটে ধরে। বলে- কি আছে সব দিয়ে দে। না হলে সমস্যা হবে। আজিজের মোবাইল ফোনটা নিয়ে ছেড়ে দিলেও, টাকা না থাকায় শামীমকে বেধড়ক মারধর করে চলে যায় তারা। এরপর আমাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে আমার মাথায় ৬টি সেলাই দেয়া হয়। কোনো ঝামেলার ভয়ে থানায় যাওয়ার সাহস পাইনি। জাহিদুল ইসলামের বাসার সামনে নদীর পাড়েই নূর মোহম্মদের দোকান। পাশেই থাকার ঘর। নদী পাড়ে ঘুরতে আসা মানুষের জন্য চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থাও আছে তার দোকানে। নূর মোহম্মদ বলেন, আমাদের এক ভাই এক্সিডেন্ট করেছিল, তাই আমি শুক্রবার ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরে এসে ভাত খেয়ে মাত্র দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি, এরই মধ্যে দেখি মিছিলের মতো লোক আসছে। কয়েকজন গিয়ে জাহিদ নামে ওই ছেলেটাকে মাথায় কোপ দিয়ে ওদের মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিলো। আর বাকিরা আমার দোকানের ভিতর ঢুকে টাকা, সিগারেট, চিপস্ যে যেমন পাইছে লুট করছে। চেয়ার-টেবিল ভেঙে চুরমার করে দিলো চোখের সামনে। তাদের হাতে থাকা অস্ত্রের ভয়ে কেউ টু শব্দও করতে পারেনি। তিনি বলেন, ঘটনার পর পর অনেকেই পুলিশকে খবর দিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে রাত সাড়ে ১১টা ১২টায়। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা আটকের কথাও শোনা যায়নি এখন পর্যন্ত।

এদিকে একই সময়ে ওই ওয়াকওয়েতে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন নুসরাত আফরিন। তারাও ছিনতাইয়ের শিকার হন। নুসরাত বলেন, গ্রিন সিটির পাশে ওয়াকওয়েতে দাঁড়িয়েছিলাম। সঙ্গে আমার এক বন্ধু ছিল। এ সময় ২৫-৩০ বছর বয়সী কিছু লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। তখন তাদের হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে আমার বন্ধু ও আমাকে পায়ের উপর বাড়ি দেয়। একপর্যায়ে ওরা আমাদের বলে, তোদের কাছে যা আছে দিয়ে দে না হলে কিন্তু মাথা গলা থেকে নামিয়ে দিবো। এ সময় আমার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। ব্যাগে কোনো টাকা না থাকায় জানতে চায় কেন টাকা নেই? এটা বলেই আমার পায়ে চাপাতি দিয়ে কোপ মারে। তখন আমি তাদের বলি, আমি তো টাকা নিয়ে বের হয়নি শুধু ফোন নিয়ে বেরিয়েছি। তারা আমার শরীরে হাত দিয়ে বাজেভাবে তল্লাশি করে। তখন আমি ভয়ে দৌড় দিলে আমার কপালের উপর আরেকটি কোপ দেয়। অন্যজন কোপ দেয় হাতের উপরে। এর মধ্যেই আমার বন্ধুর মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে একাধিক কোপ দেয়া হয়েছে। নুসরাত বলেন, কোপ দেয়ার পরে আমি আবার জোরে দৌঁড় দেই। সেখানে অনেক মানুষ ছিল। সকলের কাছে হাত জোর করে সাহায্যে চেয়েছি। ছিনতাইকারী ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করেছি কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। যখন সবকিছু ছিনতাইকারী নিয়ে চলে যায় তখন সবাই এসে বলে, আপনার কপাল কেটে গিয়েছে, রক্ত পড়ছে আপনি হাসপাতালে যান। একটু সামনের দিকে এগিয়ে শুনতে পাই ওরা আমার মতো আরও অনেকের সঙ্গে এমন করেছে। এরপর বাসায় গিয়ে কোনোমতে টাকা ম্যানেজ করে হাসপাতালে যাই। এই ঘটনায় অভিযোগ দিতে রাতেই আমি ঢাকা উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়িতে যাই। তারা ব্যবস্থা না নিয়ে আমাকে মোহাম্মদপুর থানায় যেতে বলেন। এই ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় অভিযোগ জানিয়েছি। সেখানেই অভিযোগ এন্টি করাতে লোক নেই বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে বসিয়ে রাখা হয়।

ছিনতাইকারীর দলটি বসিলা গার্ডেন সিটি হয়ে ওয়াকওয়ের দিকে যাওয়ার সময় কুপিয়ে আহত করে আরও অনেককে। প্রনামী ভ্যারাইটিজ স্টোরের সামনে দুইজন নির্মাণ শ্রমিকের হাতে পায়ে কোপ দিয়ে তাদের মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় প্রনামী ভ্যারাইটিজ স্টোরের মালপত্রও লুট করে তারা। এর অদূরে হোন্ডা কোম্পানির ওয়ার্কশপের পাশের রাস্তায় আরও কয়েকজন ছিনতাইয়ের শিকার হন। ওই রাস্তার দুইপাশের এমন কোনো দোকান নেই যেখানে লুট চালায়নি ওই চক্রটি। বসিলা গার্ডেন সিটি জামে মসজিদ মোড় থেকে নদী পাড়ের ওয়াকওয়ে পর্যন্ত পুরো রাস্তার দুপাশের দোকান, রাস্তার পথচারী যাকেই সামনে পেয়েছে তার ওপরই হামলে পড়েছে চক্রটি।

ওই রাস্তাতেই চায়ের দোকান চালান আরিফুল ইসলাম। শুক্রবার সন্ধ্যায় তার দোকানেরও ক্যাশ বাক্স ভেঙে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী দল। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাচালকও রেহাই পায়নি। আরিফ বলেন, সন্ধ্যা ৭টা বাজে আমি দোকানে চা বানাচ্ছি। সামনে বেঞ্চে কয়েকজন বসে চা খাচ্ছিল। রাস্তায় একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। এরই মধ্যে ৪০/৫০ জনের একটা দল এসে বেঞ্চে বসা দুজনের গলায় ছুড়ি ধরে মোবাইল কেড়ে নেয়। কয়েকজন রিকশাচালকের ফোন ও টাকা নিয়ে নেয়। আমি তখনো ক্যাশে বসে। এরমধ্যেই আমার দোকানের খুঁটিতে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয় তারা। আমি তখন ভয়ে পিছনে চলে যাই। এ সময় কয়েকজন আমার ক্যাশ ভেঙে টাকা নিয়ে নেয়। বেশ কয়েক কার্টন সিগারেট ছিল তাও নিয়ে যায়। কয়েকজন মিলে দোকানে রাখা পানির বোতলের কেস ধরে তুলে নিয়ে চলে যায়। অস্ত্রের ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। পরে আমরাসহ বেশ কয়েকজন পুলিশে খবর দেই। জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করা হয়। তারপরও পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে রাত ১২টায়। এসে কোনো রকম খোঁজ নিয়ে চলে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক বলেন, এর আগেও অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই হাউজিং এর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও থানায় অভিযোগ করলেও কোনো ফল পাইনি। বসিলা গার্ডেন সিটির দায়িত্বে থাকা মো. শামীম বলেন, হাউজিং এর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. আজিজুল হক বলেন, মোহম্মদপুর বসিলা এলাকায় অনেকগুলো হাউজিং গড়ে উঠেছে। হাউজিংগুলো নিজেরাই তাদের নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখেন। তবে বসিলা গার্ডেন সিটির পক্ষ থেকে কখনোই নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের বিষয়ে আমাদের অনুমতি চাওয়া হয়নি। তিনি বলেন, বিষয়টির খোঁজখবর নিয়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিবো। একইসঙ্গে ছুটির দিনে ওয়াকওয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হবে বলে তিনি জানান।

আরো পড়ুন : কোনো ধরনের শর্ত মেনে বিদেশে চিকিৎসা নিতে রাজি নন খালেদা জিয়া

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *