দেশের রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে কৌতূহল কাটছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। দলটির নেতারা বলছেন, শুধু সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্যই আলোচনার বাইরে থাকা মো. সাহাবুদ্দিনকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বেছে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বাছাইয়ে অতি গোপনীয়তা অবলম্বন ও আলোচনায় থাকা পুরোদস্তুর রাজনীতিকের বাইরে একজনকে বেছে নেওয়ার পেছনে কী বিবেচনা কাজ করেছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন নেতারা।
গত দুই দিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্য মিলিয়ে ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে—কয়েক মাস ধরে রাষ্ট্রপতি পদে যাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেসব নাম হাওয়া থেকে আসেনি। এর পেছনে দলের নেতাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় যেমন ছিল, একই সঙ্গে দলটির নেতাদের অনেকের একধরনের সংগঠিত চেষ্টাও ছিল। কোনো কোনো ব্যক্তির দেশীয়-আন্তর্জাতিক যোগাযোগও কাজ করেছে। কিন্তু শেষবিচারে দল বা দলের নেতাদের চিন্তা বা পছন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনকে বেছে নেওয়াকে কোনো কোনো নেতা বলছেন ‘পারিবারিক’ সিদ্ধান্ত। এ জন্যে গত রোববার সকালে প্রকাশ হওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় সবাই ছিলেন অন্ধকারে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কিছুটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ভাবছে দলের উচ্চপর্যায়। এর মধ্যে বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনা, ভোটে পুনরায় দলকে জয়ী করে সরকার গঠন এবং সেই সরকারকে স্থিতিশীল রাখার বিষয় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ জন্য দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিষয়টি গোপন রেখে নিজের বিবেচনাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে পরিবারের দু-একজন সদস্যের মতামত নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্য যাঁরা আলোচনায় ছিলেন, দল ও সরকারের প্রতি তাঁদের কারও অবদান নিয়ে প্রশ্ন নেই। এটা দলীয় প্রধানও জানেন। এ জন্যই কাকে বিবেচনা করা হচ্ছে, কে বিবেচনায় নেই—এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি প্রধানমন্ত্রী। এমনকি যাঁরা অতীতে নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও জানতে পারছিলেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, সংসদীয় দলের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি বেছে নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
তিনি এমন একজনকে বেছে নিয়েছেন, যাঁর দেশের প্রতি ও সংবিধানের মূলনীতির প্রতি পুরোপুরি আস্থা রয়েছে। আবার অশান্তি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধেও তাঁর শক্ত অবস্থান থাকবে। গোপনীয়তার বিষয়ে তিনি বলেন, দলের সভাপতির ওপর দায়িত্ব অর্পণের পর কে জানল, কে জানল না, সেটা তো বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। এ ছাড়া দল ও সরকারে যে শৃঙ্খলা আছে, এটাও প্রমাণিত হলো।
বিবেচনায় যা এসেছে
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি করার অভিজ্ঞতা সুখকর মনে করে না আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। ২০০৯ সালে পুরোদস্তুর রাজনীতিক জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর আরেক রাজনীতিক মো. আবদুল হামিদকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁরা দুজনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১৯৭০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক নেতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি কারাবরণ করেছিলেন। এরপর তিনি বিচারক হিসেবে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রিসভার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মো. সাহাবুদ্দিন গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি কিংবা অন্য বড় কোনো পদে যাওয়ার কথা হয়তো কখনো ভাবেননি তিনি। তাঁকে রাষ্ট্রপতি করার ফলে দল, দলীয় প্রধান ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এটাই হয়তো দলীয় প্রধান চেয়েছেন।
আরেকটি সূত্র বলছে, মো. সাহাবুদ্দিন দীর্ঘদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে বিবেচনার পর তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সরকারিভাবে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।
মো. সাহাবুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘ ক্যারিয়ারের কারণে সাহাবুদ্দিনের চলাফেরার জগৎ যতটা বড় হওয়ার কথা, ততটা নয়। তিনি অনেকটা ‘লো প্রোফাইল’ চলাফেরা করেছেন। এটাও হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ করার কারণে রাষ্ট্র সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতেও সুবিধা হবে তাঁর।
দলে নাম নিয়ে আলোচনা হয়নি
দলীয় সূত্র বলছে, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কাকে করা যায়—এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামে সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি পদে দলের প্রার্থী বাছাই করতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ প্রস্তাবে সবাই সায় দেন। ফলে ওই বৈঠকে আর কোনো ব্যক্তির নাম নিয়ে আলোচনা হয়নি।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরার এ বিষয়ে সংসদীয় বোর্ড, সভাপতিমণ্ডলী কিংবা দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হয়নি।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতি বাছাইয়ের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কোনো রাজনীতিকের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন—এমন তথ্য কারও কাছে নেই। বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সংসদ অধিবেশন চলাকালে একদিন বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো পছন্দের প্রার্থী আছে কি না, তা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তাঁর পছন্দ না থাকার কথা জানান বলে সূত্র জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে আলাপ করেননি, এটা হয়তো ঠিক নয়। তবে রাজনীতির বাইরে কারও কারও সঙ্গে পরামর্শ করে থাকতে পারেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি পদে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরিবারের একেবারে ঘনিষ্ঠদের নিয়ে আলোচনা করেছেন শেখ হাসিনা।
যে কারণে গোপনীয়তা
রাষ্ট্রপতি পদে কে আসছেন—এ বিষয়ে রোববার সকাল নয়টা পর্যন্তও আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য অন্ধকারে ছিলেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কারও কাছে আগাম তথ্য না থাকার বিষয়ে অনেকে বিব্রত বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। অবশ্য মো. সাহাবুদ্দিন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন—এমন বার্তা রোববার সকাল থেকে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করেন। তাঁরা অবশ্য আওয়ামী লীগের অন্দরমহলের কেউ নন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সাত থেকে আটজন কেন্দ্রীয় নেতা রোববার নির্বাচন কমিশনে যান। এর আগে রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থী কাকে করা হচ্ছে, তা জানার জন্য নেতারা গণভবনে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নেতারা গণভবনে গিয়ে মো. সাহাবুদ্দিনকে দেখতে পেয়ে কিছুটা বিস্মিত হন। পরে ফরম পূরণের জন্য সবাই নির্বাচন কমিশনে যান।
আওয়ামী লীগের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টেলিভিশনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতাদের দেখে বোঝা যায়, তাঁদের চোখে-মুখে বিস্ময় স্পষ্ট ছিল। তাঁরা কিংবা দলের নেতারা অখুশি-এটা নয়। তবে সবার অজান্তে কিংবা চিন্তার বাইরে এমন কাউকে বেছে নেওয়া হবে—সেটা হয়তো তাঁরা ভাবেননি।
আরেকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, এক–এগারোর পর দলীয় নেতাদের বিষয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা বিতর্ক আছে। রাষ্ট্রপতি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অতি গোপনীয়তা রক্ষা করায় বিষয়টি পুনরায় সামনে এনেছে।
দলীয় সূত্র বলছে, সাধারণত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো তথ্য প্রধানমন্ত্রী নিজে দলের ফোরামে জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে প্রকাশ করেন। অথবা নেতারা জানতে চাইলে কখনো কখনো প্রকাশ করেন। এবার এর কোনোটাই হয়নি। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং মন্ত্রী পদমর্যাদার নেতা অন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে কাকে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করেন। ওই মন্ত্রী সংসদে বিষয়টি নিয়ে কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপরই নেতারা অনেকটা হাল ছেড়ে দেন।
আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে বেশ কজন নিজেই রাষ্ট্রপতি পদের দাবিদার ছিলেন। তাঁদের পক্ষে-বিপক্ষেও তৎপরতা ছিল। সব অনুমানের বাইরে মো. সাহাবুদ্দিনকে বেছে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট নন আওয়ামী লীগের নেতারা।
আরো পড়ুন : বিএনপি কর্মীর মার্কেটে ‘তালা’ মারল আওয়ামী লীগ নেতারা