৯ বছর আগে (২০১৩ সাল) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে হত্যা করা হয়। চার বছর আগে মামলাটির আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। মামলার সাক্ষী ৭৫ জন। তবে এই চার বছরে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র চারজন।
বিচারে এমন ধীরগতির কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আ ফ ম রিয়াজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৪ বছর আগে মামলার ১৮ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর পর যথাসময়ে আদালতে সাক্ষী আসেননি। আদালত থেকে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও শুনানির অনেক তারিখে সাক্ষী হাজির হননি।
মিল্কি হত্যার বিচার অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় গত ২৪ মার্চ খুন হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। এ হত্যাকাণ্ডে ইতিমধ্যে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মতিঝিলকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিরোধ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিরোধের জেরে জাহিদুল খুন হয়েছেন।
যুবলীগ নেতা মিল্কি খুনের পর তদন্তে সময় লেগেছে দুই বছর। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তিন বছর পর বিচার শুরু হয়। মামলার নথিপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মিল্কি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত ঢাকা মহানগর যুবলীগের (উত্তর) বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পর গত ২০ মার্চ পর্যন্ত ১৪ বার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত। এর মধ্যে আটবার রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বারবার সাক্ষী হাজির করার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে।
মিল্কি হত্যা মামলাটি ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত পঞ্চম দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। তবে সম্প্রতি এ মামলা ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলি করা হয়েছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে মিল্কি খুনের মামলার বিচারে গতি পায়নি। বিচার চলছে কচ্ছপগতিতে।
রাজনৈতিক বিরোধ, চাঁদাবাজিসহ নানা বিরোধের জের ধরে ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের বিপণিবিতানের সামনে মিল্কিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিপণিবিতানের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় এ খুনের দৃশ্য ধরা পড়ে।
রাতেই উত্তরার একটি ক্লিনিক থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক জাহিদ সিদ্দিকী তারেকসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই বছরের ৩১ জুলাই রাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন জাহিদ সিদ্দিকীসহ দুজন। এ ঘটনায় নিহত মিল্কির ভাই মেজর রাশেদুল হক খান বাদী হয়ে জাহিদ সিদ্দিকীসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে গুলশান থানায় মামলা করেন। এর এক দিন পর এ খুনের মামলা তদন্তে র্যাবকে দায়িত্ব দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
যে কারণে মিল্কি খুন হয়েছিলেন
মিল্কি হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকা মহানগর যুবলীগের (উত্তর) বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাব। তবে বাদীপক্ষ থেকে নারাজি দিলে পরে মামলার তদন্তভার যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। সিআইডির তিন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেন। ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সাখাওয়াতসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস।
অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, মিল্কি, জাহিদ সিদ্দিকী এবং মিল্কির গাড়িচালক (মামলার সাক্ষী) মারুফ রেজা একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। মিল্কি ১০ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। জাহিদ সিদ্দিকী ছিলেন ওই কমিটির সদস্য।
আর সাক্ষী মারুফ রেজা ছিলেন ওই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মিল্কি ও জাহিদ সিদ্দিকী একত্রে বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নেগোসিয়েশন করতেন। ২০১১ সালে জাহিদ সিদ্দিকী রেলওয়ের ঠিকাদারির ১৫ লাখ টাকা মিল্কিকে না জানিয়ে নিজে নিয়ে নেন এবং তা খরচ করে ফেলেন। পরে মিল্কি বিষয়টি জানার পর তাঁদের মধ্যে প্রথম ভুল–বোঝাবুঝি শুরু হয়। এরপর জাহিদ সিদ্দিকীর কাছে ডিশ ব্যবসার হিসাব চান মিল্কি। কিন্তু জাহিদ সিদ্দিকী এই হিসাব না দেওয়ায় তাঁদের মধ্যে বিরোধ চরম পর্যায়ে যায়। এর পর থেকে দুজনে আধিপত্য বজায় রাখতে মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকা থেকে পৃথক মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে যাওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে শোভাযাত্রা করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১১ সালের শেষের দিকে মতিঝিল থানা যুবলীগের কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হলে মিল্কি ও জাহিদ সিদ্দিকী সভাপতি হতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাঁদের দ্বন্দ্বের জেরে আর মতিঝিল থানা যুবলীগের কমিটি ঘোষণা হয়নি। এমন অবস্থায় ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। তখন মতিঝিলের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কমিশনার হিসেবে মিল্কি এবং মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুসহ আলতাফ, ফারুক, মাশরুর, মনসুর, বাচ্চু, বাবু, চিকু, নওশের ও রাজু নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেন। ওই প্রচারণায় মিল্কির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন জাহিদ সিদ্দিকী। তিনি জাহিদুল ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে তখন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আর হয়নি।
অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, তখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটি নির্বাচনকালে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ওয়াহিদুল আলমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মিল্কি। তিনি অপর সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী রেজাউল করিমের পক্ষে অবস্থান নেন। আর ওয়াহিদুলের পক্ষে অবস্থান নেন জাহিদ সিদ্দিকী। ২০১৩ সালের কমিটিতে মিল্কি দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। আর জাহিদ সিদ্দিকী হন যুগ্ম সম্পাদক। এর পর থেকে মিল্কিকে রাজনীতিতে কোণঠাসা করতে সচেষ্ট হন জাহিদ সিদ্দিকী। পাশাপাশি মতিঝিলের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন জাহিদ সিদ্দিকী। তবে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ান মিল্কি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিল্কির বন্ধু রবিনের সঙ্গে ঠিকাদারির বিল নিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাখাওয়াত হোসেনের দ্বন্দ্ব হয়। সাখাওয়াতের সঙ্গে রবিনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিল্কিই। সাখাওয়াতের ৪০ লাখ টাকা রবিন আটকে দিলে রবিনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়। রবিনের পক্ষে মিল্কি অবস্থান নেওয়ায় ৪০ লাখ টাকা থেকে বঞ্চিত হন সাখাওয়াত। এ কারণে সাখাওয়াতের চরম শত্রুতে পরিণত হন মিল্কি। এসব বিরোধের জের ধরে মিল্কি খুন হন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
সাক্ষীরা যা বলেছেন আদালতে
মিল্কি খুনের মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হলেন মারুফ রেজা। মারুফ আদালতকে বলেন, সেদিন লালমাটিয়ার বাসা থেকে মিল্কিকে নিয়ে গাড়িতে করে গুলশানে যান। যাওয়ার আগে মিল্কি তাঁকে জানান, তাঁকে গুলশানে যেতে হবে। কানুন ভাই ডেকেছেন। মিল্কি গাড়ি থেকে নেমে যখন শপার্স ওয়ার্ল্ডের প্রধান ফটকের দিকে যেতে থাকেন, তখন সাদা পাঞ্জাবি পরা (মাথায় টুপি ছিল) জাহিদ সিদ্দিকী গুলি করেন। মিল্কি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। সেই সময় সাখাওয়াতের গাড়ি থেকে নেমে মিল্কিকে লক্ষ্য করে গুলি করেন আমিনুল।
মামলার বাদী মিল্কির ভাই রাশেদুল আদালতে বলেন, রাজনৈতিক শত্রুতার কারণে সাখাওয়াত, সোহেল, জাহাঙ্গীরসহ অন্যরা তাঁর ভাইকে গুলি করে হত্যা করেন। রাজনৈতিক জীবনে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে জাহিদুল ইসলাম ও ওয়াহিদুল আলমের ইশারা ও নির্দেশে তাঁর ভাইকে হত্যা করা হয়।
মিল্কির স্ত্রী ফারহানা খানমও আদালতে বলেন, তাঁর স্বামী কমিশনার পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তবে জাহিদুল ইসলাম, ওয়াহিদুল ও জাহিদ সিদ্দিকী শত্রুতা করেন। অবশ্য আসামিপক্ষ থেকে আদালতের কাছে দাবি করা হয়েছে, তাঁরা এ খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চেয়েছেন।
১৮ জনের ৪ জন আজও পলাতক
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৮ জনের মধ্যে ১৪ জন জামিনে আছেন। পলাতক চারজন। তাঁরা হলেন সাখাওয়াত হোসেন, ফাহিমা সুলতানা, শরিফ উদ্দিন চৌধুরী ও সৈয়দ মুজতবা আলী। জামিনে আছেন আমিনুল ইসলাম, সোহেল মাহমুদ, চুন্নু মিয়া, আরিফ হোসেন, সাহিদুল ইসলাম, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ, জাহাঙ্গীর মণ্ডল, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, তুহিন রহমান, মোহাম্মদ রাশেদ মাহমুদ, সাইদুল ইসলাম, সুজন হাওলাদার, চিকিৎসক দেওয়ান মো. ফরিদউদ্দৌলা ও মামুন উর রশীদ।
আরো পড়ুন : ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হাজি সেলিম দেশে ফিরলেন