গত মঙ্গলবার সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানায় তেহরান, যা ছিল গত ৩ জানুয়ারিতে ইরানের প্রভাবশালী কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুবার্ষিকীর ভিড়ে আত্মঘাতী হামলার প্রতিশোধ।
সেই হামলার দায় স্বীকার করেছিল ইসলামিক স্টেট। আরব বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠা ইরানের প্রক্সি বাহিনী আইআরজিসির মূল কারিগর সোলাইমানি ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন।
ইরান একই দিন ইরাকে হামলা চালানোর কথাও জানায়। তাদের দাবি, তারা ইরাকে অবস্থিত ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। যদিও ইরাক সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরাইল লেবানন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ এবং ইরানের রেভুল্যুশনারি গার্ডের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার ইরানে হামলা চালিয়েছে। তেহরান আগের দিন একই ধরনের হামলা চালানোর পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। দুই দেশই বলেছে— জঙ্গি আস্তানার বিরুদ্ধে এ হামলা চালানো হয়েছে।
ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে ইরানের সব হামলার পেছনেই ছিল নিজেদের মাটিতে বা নিজেদের স্বার্থ আক্রান্ত হওয়ার জেরে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা।
ইসরাইল-ইরান দ্বন্দ্বের কারণ কী?
সিরিয়া ও ইরাকে হামলার পরের দিন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে জঙ্গি সংগঠন জৈশ আল-আদলের দুটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইরান। প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান বৃহস্পতিবার ভোরেইরানের দক্ষিণাঞ্চলে জঙ্গি আস্তানার কথা বলে হামলা চালায়। সেই হামলায় নারী-শিশুসহ ৯ জন নিহত হন।
সুলেইমানির নেতৃত্বে আরব বিশ্বজুড়ে প্রক্সি বাহিনীর বৃহত্তর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে ইরান। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাহিনীগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
অবশ্য ইরান ওইসব বাহিনীর সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টার কথা অস্বীকার করে। বলে, তারা শুধু ওই বাহিনীগুলোর ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করে।
গাজা, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন— সবকটি দেশেই ইরানের ওইসব প্রক্সি বাহিনী সক্রিয় আছে এবং লড়াই করে যাচ্ছে।
পাকিস্তান-ইরান উত্তেজনা
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে সুসময় ও দুঃসময়-দুটোই ছিল। ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে এবং ভূ-রাজনীতিতে তারা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।
১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এবং পাকিস্তানে সৌদি-অনুপ্রাণিত ওয়াহাবি ধারার ইসলাম চর্চা বাড়তে থাকলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।
১৯৯০-এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উসকানি দেওয়ার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। আর অন্যদিকে এই সময়ে কাবুলভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি ছিল তেহরানের।
ভারতের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোর বিষয়টি দুই দেশকে পরস্পর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
২০১৮ সালে ইরান যখন চাবাহার নামে দেশটির সমুদ্রবন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নয়াদিল্লির হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে, তখন ইসলামাবাদ এটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তানে এই বিষয়টিকে গোওয়াদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব কমিয়ে আনতে ভারত ও ইরানের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে গোওয়াদার বন্দর।
এত সব অবনতির মধ্যেও দুই দেশ বড় কোনো দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। আবার তারা তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কখনো ব্যবহারও করেনি।
ইসলামাবাদের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো আরহামা সিদ্দিকা বলেন, ২০২১ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলছিল। কিন্তু তার পরও পাকিস্তান বেশ সতর্কতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে।
আরো পড়ুন : ইসলামিক জীবনে শপথ ভঙ্গের কাফফারা কী?