বিশেষ প্রতিবেদক : ব্যাংক জালিয়াতি ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, তার স্ত্রী মোসাম্মৎ জোবেদা বেগম এবং তাদের দুই ছেলে কাউছার আহমেদ অপু ও মেহেদী হাসান দিপুর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে ঘটনা বড় হওয়ার কারণে অনুসন্ধান শেষ করতে সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হোসাইন এ প্রতিবেদককে বলেন, রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। কবেনাগাদ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। ঘটনা বড় হওয়ার কারণে অনুসন্ধান শেষ হতে সময় লাগবে।
জানা গেছে, রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, তার স্ত্রী মোসাম্মৎ জোবেদা বেগম এবং তাদের দুই ছেলে কাউছার আহমেদ অপু ও মেহেদী হাসান দিপুর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করতে দুদক গত বছরের ৩ মার্চ উপপরিচালক নাজমুল হোসাইনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে। দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, নথির বিষয়োক্ত অভিযোগটি যাচাইয়ের জন্য আপনাকে যাচাইকারী কর্মকর্তা এবং পরিচালক (মানি লন্ডারিং)-কে তদারককারী কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪; দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এর বিধান মোতাবেক দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাই সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয় ওই চিঠিতে। অনুসন্ধানকালে অভিযোগসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধকরণ অথবা কোনো সম্পদ/সম্পত্তি ক্রোক করা হলে তা সংশ্লিষ্ট শাখাকে অনতিবিলম্বে লিখিতভাবে অবহিতকরণের অনুরোধ জানানো হয়।
সূত্র জানান, আইয়ুব হোসেন নামে এক সাংবাদিক সম্প্রতি ব্যাংক জালিয়াতির মাধ্যমে ২৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করেন। এ অভিযোগে বলা হয় : ২০২২ সালে বিক্রি হয়ে যাওয়া রাজধানীর জোয়ারসাহারা, ভাটারা ও গুলশান মৌজার ৩৩৭.৫৯ শতাংশ জমির দলিল চলতি বছর বন্ধক রেখে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা থেকে এ ঋণ নেন। তিন দফায় এ ঋণ ছাড় করা হলেও এ টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা হয়েছে সে বিষয়ে তথ্য নেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে। অথচ ওই জমিতে গিয়ে জানা যায়, রফিক যাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন তারাই ভোগদখলে আছেন। এ ধরনের জালিয়াতি রোধে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার আগে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার জন্য ইস্ট-ওয়েস্ট প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেও রংধনু গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার আগে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক কোনো অনাপত্তিপত্র নেয়নি। বিষয়টি অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকে অভিযোগটি করেন তিনি।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ জুন রংধুন গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, তার ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাউসার আহমেদ অপু ও মালিহা হোসেন জোয়ারসাহারা, ভাটারা ও গুলশান মৌজার ৩৩৭ দশমিক ৫৯ ডেসিমাল জমি বন্ধক রেখে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা থেকে ২৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ভাটারা মৌজার চারটি প্লটে রফিকুল ইসলামের বিক্রি করে দেওয়া ৯৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ জমিও রয়েছে। রফিকুল ইসলাম যেসব জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেখানে মূল মালিক আবুল কাশেমের ড্রিমওয়ে হোল্ডিংস লিমিটেডের বহুতল ভবন নির্মাণের সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে। নির্মাণ চলছে আরেক মালিক তামান্না সুলতানার বহুতল ভবনও। অথচ রফিক জমি বিক্রির তথ্য গোপন রেখেই এ বছরের ২২ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন ২৭০ কোটি টাকা।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমি দখল, হত্যাচেষ্টা ও লুটপাটের অভিযোগে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের নামে দুটি মামলা করা হয়েছে। এদিকে চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর রফিকসহ ১৮ জনকে আসামি করে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলা আবেদন করেন ভুক্তভোগী আলী আজগর ভূঁইয়া ও মো. মামুন। মামলায় রফিকসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করেন মামুন। আর আলী আজগরের মামলায় ৩১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কায়সার আলমের আদালত শুনানি শেষে মামুনের অভিযোগটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং আলী আজগর ভূঁইয়ার আবেদনটি গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার অভিযোগে মামুন জানান, গত ১৭ অক্টোবর আসামিরা তাদের পাঁচ ভাইয়ের মালিকানাধীন ৯৫ শতাংশ জমি রফিক ও মিজানুরের নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে হুমকি দেন। নইলে তাদের গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেন তারা। পরে ১৯ অক্টোবর সকালে আসামিরাসহ আরও অজ্ঞাত ৩০-৩৫ জন দেশি অস্ত্র নিয়ে এসে জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে হুমকিধমকি দেন। সর্বশেষ ২১ অক্টোবর আসামিরা বাড়িতে এসে হামলা-ভাঙচুর করেন এবং গাভিসহ ঘরের প্রায় ১৬ লাখ টাকার মালামাল লুট করে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যান। এ সময় আসামিরা বসতঘর ও গোয়ালঘরে আগুন ধরিয়ে দেন। পুনরায় তারা জমি রেজিস্ট্রি করে লিখে দিতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
অন্য মামলার বাদী আজগর আলী ভূঁইয়া জানান, গত ১৮ নভেম্বর আসামিরা দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে তার বাড়িঘরে ভাঙচুর চালান এবং আসবাবপত্র, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১২ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যান। এ সময় আসামিরা দ্রুত জমি তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে লিখে দিতে হুমকি দেন। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান জানান, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কায়সার আলমের আদালত শুনানি শেষে মামুনের অভিযোগটি রূপগঞ্জ থানায় এফআইআর করার এবং আলী আজগর ভূঁইয়ার আবেদনটি ডিবিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
আরো পড়ুন : নৌকার জন্য অশনি সংকেত দিচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা