নিজস্ব প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। ছাত্র অধিকার পরিষদ গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার আগেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলেও মূল দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন করে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার একক সিদ্ধান্ত নেবে না। সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা একটি বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। এখনো এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়নি।
একই প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অনেকে দাবি জানাচ্ছেন। তবে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমরা এ নিয়ে সংলাপ করব। তারা (রাজনৈতিক দলগুলো) যদি চায়, (আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে) সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকার যে একক সিদ্ধান্ত নেবে না তার প্রমাণ মিলেছে আগেই। ‘সারডা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষে গত ১৯ আগস্ট এ বিষয়ে রিট করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রিটে বিরোধিতা করে। গত ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রিট খারিজ করে দেন। এরপর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর ধরে হত্যা, গুম, ব্যাপক দুর্নীতি এবং ভোট কারচুপির মাধ্যমে একাধিকবার ক্ষমতায় আসার অভিযোগ ছিল। সর্বশেষ কোটা আন্দোলন ইস্যুতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশে ছাত্র-জনতার ওপর যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে তাতে এই দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার হারিয়েছে বলে মনে অনেকে মনে করছে। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের যে সংলাপ হচ্ছে সেখানেও এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ছাত্রলীগকে যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই একই প্রক্রিয়ায় প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে না সরকার। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে চাইছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে একাধিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে মতামত দিলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সেটি চাইছে না। এরই মধ্যে দলটির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেটি স্পষ্ট করেছেন।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দলের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। আমরা চাই না, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। কারণ, আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আওয়ামী লীগের যারা নানা অপরাধ করেছেন, যারা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না।’
আরেক রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামীও এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেনি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার বিষয়েও মতামত দিয়েছেন। গত ১৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ শেষে বেরিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আওয়ামী লীগসহ যেসব দল গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে রাজনীতির সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তবে দলগুলো নিষিদ্ধ হবে কি না এটি বিচারের বিষয়। কিন্তু সে পর্যন্ত এই দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা উচিত।
আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবে : রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখা হতে পারে। এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হতে পারে বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। সে রকম কিছু হলে তার প্রক্রিয়াটি কী হবে তা নিয়েও কাজ চলছে। চলমান আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে মানবতাবিরোধী কার্যক্রম ও গণহত্যার দায় প্রমাণিত হলে, নির্দিষ্ট মেয়াদে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সভায় গণহত্যায় কোনো বাহিনী বা দলের সম্পৃক্ততায় গুম, খুন যৌন নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ও জড়িত রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর নিষিদ্ধ করাসহ আটটি সংশোধনীর প্রস্তাব করে আইন মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক মতৈক্য হলে এই সংশোধনীর আলোকে ১০ বছরের জন্য নির্বাচনে নিষিদ্ধ হতে পারে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি।