রাতের ঢাকা এখন ভয়ংকর

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ জাতীয় প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাতের ঢাকা। রাজধানীর রাস্তায় হাঁটা কিংবা যানবাহনে চলাচল বলেন, সর্বত্রই চরম নিরাপত্তাহীনতায় নগরবাসী। সুস্থ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে ভালোভাবে ফিরতে পারবেন কি না এ নিয়ে শঙ্কায় নগরবাসীর অনেকের। রাজধানীতে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ ও হতাশা কাটছে না নগরবাসীর। খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার সাজ্জাত আলী বারবার এ ব্যাপারে রাজধানীবাসীকে আশ্বস্ত করলেও শঙ্কা কাটছে না তাদের।

গত ১৭ ডিসেম্বর ভোর ৪টা ৩২ মিনিট। রাজধানীর কলাবাগানের লেকসার্কাস ডলফিন গলি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন পাহাড়ি জ্যোতি বসু চাকমা দম্পতি। হঠাৎ করেই মোটরসাইকেল থেকে নেমে হেলমেট পরিহিত এক যুবক চড়াও হয় ওই নারীর ওপর। বড় চাপাতি বের করে মহিলার কাঁধে থাকা ব্যাগের বেল্টে কোপ দিয়ে তা ছিনিয়ে নেয়। জ্যোতি বসুর ফোনটি দিতে না চাইলে তাকে বেধড়ক কোপিয়ে এক পর্যায়ে ফোনসহ বাকি সবকিছুই ছিনিয়ে নেয়। ভয়ংকর এ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ভুক্তভোগী জ্যোতি বসু চাকমা বলেন, মোটরসাইকেলে করে তিনজন আমাদের সামনে আসে। দুজনের হাতে চাপাতি ছিল। তারা আমার স্ত্রীকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। তার কাছ থেকে আইফোন ১৩, হাতে থাকা আঙটি ছিনিয়ে নেয়।

স্থানীয়রা বলছেন, ঠিক একই জায়গায় ১৪ ডিসেম্বর ভোরেও এক নারীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছিনতাইকারীরা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল। কলাবাগান এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যাওয়ার কারণে যাত্রীরা এখানে আসতে বাধ্য হন। শেষ রাতের দিকেও অনেক বাস এখানে যাত্রী নামিয়ে দেয়।

গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদগেট এলাকায় একটি প্রাইভেটকারের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার দৃশ্য ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। মাজহারুল ইসলাম মহসিন নামে ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। একই জায়গায় গত ২১ ডিসেম্বর রাতে প্রকাশ্যেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছিনতাইকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী এনামুল হক রবির কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। ভুক্তভোগী রবির বাম হাত মারাত্মকভাবে কেটে যায়। তার মাথা ও হাতে ২৪টি সেলাই পড়েছে।

এদিকে, রাজধানীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ২ কোটি রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ছিনতাইপ্রবণ এলাকাগুলোয় আমরা ফুট, মোটরসাইকেল এবং গাড়ি পেট্রল বাড়িয়েছি। সেখানে পর্যায়ক্রমে জোনের এসি, এডিসি দায়িত্ব পালন করছেন। সবকিছুই ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা খুব শিগগিরই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার চিহ্নিত অপরাধীরা যাতে শিগগিরই জামিন না পান সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। জামিনে বের হয়ে আসা অপরাধীদেরও নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে। পুলিশ সদস্যদের মাঝে এখনো অজানা ভয় কাজ করছে। অপরদিকে, ছিনতাইসংক্রান্ত মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় সর্বাধিক তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। চলতি বছর ঢাকায় জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের মামলা ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬ ও জুলাইয়ে ১৫টি। সবমিলিয়ে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। চলতি বছর ঢাকায় জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের মামলা ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬ ও জুলাইয়ে ১৫টি।

অপরাধমূলক কর্মকা বাড়ছে কেন- এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধ চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এ ক্ষেত্রে সেনাসদস্যদের আরও কঠোর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। নয়তো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, রাতের ঢাকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে র‌্যাব। রাজধানীর সবকটি ব্যাটালিয়নকে এ-সংক্রান্তে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সদর দপ্তর থেকে। চুরি-ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় বাড়ানো হয়েছে টহল এবং চেকপোস্ট।

আরো পড়ুন : ৩১ ডিসেম্বর, আজকের দিনে জন্ম-মৃত্যুসহ যত ঘটনা

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *