তৈরি পোশাক বাণিজ্যে এখন সুদিন। পোশাকে ভর করে গত ডিসেম্বরে একক মাসে রেকর্ড ৫৩৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই ভাঙছে আগের মাসের রপ্তানি রেকর্ড। চীন-ভিয়েতনামের জন্য ক্রেতাদের বরাদ্দ রাখা রপ্তানি আদেশও পাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অনিরাপদ অবস্থা থেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ কর্মপরিবেশ বাংলাদেশের পোশাক খাতে। কোনো কোনো ব্র্যান্ড ও ক্রেতা পোশাক খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করতে অন্যান্য দেশকে পরামর্শ দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতের এই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু রানা প্লাজা ধসের পর। ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিলের এ দুর্ঘটনায় দেশে-বিদেশে তিরস্কারের ঝড় ওঠে। কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ না থাকার অভিযোগে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একই সুবিধা স্থগিতের হুঁশিয়ারি আসে জোটগত প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। বাংলাদেশের পোশাক ব্যবহার না করার জন্য বিভিন্ন দেশে মিছিল, প্রচার-প্রচারণার নামে গ্রিন গ্রোথ ক্যাম্পেইন, ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক অনেক শ্রমিক সংগঠন। খাদের কিনারে ঠেকে পোশাক খাত। এ রকম বৈরী বাস্তবতায় উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স এবং ইউরোপের ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম। এর সুবাদে নিরাপদ খাত হিসেবে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প। বেড়েছে ক্রেতাদের আস্থা।
তবে অনেকটাই উপেক্ষিত থেকে গেছে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা, যথাযথ ক্ষতিপূরণ, তাঁদের জীবিকা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার ১০ বছর পরও আহতরা পরিবার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাভারে রানা প্লাজা ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ এখনও কর্মহীন। শারীরিক পঙ্গুত্বই শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। এত দিনেও বেঁচে যাওয়াদের শারীরিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। অন্তত ২২ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ২৯ শতাংশ নানা রকম মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি শ্রমিকদের। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। তবে শ্রমিকের উন্নতি সে হারে হয়নি। মূল্যস্ফীতির চাপে শ্রমিকরা কোণঠাসা।
রানা প্লাজা ধসে আহতদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ট্রাস্ট ফর ইনজুরড ওয়ার্কার্স মেডিকেল কেয়ার (টিআইডব্লিউএমসি) নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয় ২০১৬ সালে। আইএলওর নেতৃত্বে ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা ও অন্যান্য বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা ক্ষতিপূরণ তহবিল থেকে এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় মারাত্মক এবং সাধারণ আহত মিলে ৩ হাজার ২০০ শ্রমিককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দু’জন শ্রমিককে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ট্রাস্টের সমন্বয়ক শাহরিয়ার রনি জানান, আহতদের আগের চেয়ে বেশি সেবা দিতে হচ্ছে তাঁদের। আহতদের চিকিৎসার সব ধরনের ব্যয় বহন করছেন তাঁরা। এমনকি গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার খরচও বহন করছেন। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর পরও দিবস পালন এবং সারা বছরের আলোচনায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রধান দাবি থাকে ক্ষতিপূরণ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন অনুযায়ী যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তাদের। এই কনভেশন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ হবে এক জীবন আয়ের সমপরিমাণ। বাংলাদেশের শ্রম আইনে ২ লাখ টাকার কথা বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণও পায়নি মৃত অনেক শ্রমিকের পরিবার। টিআইডব্লিউএমসি সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৬১ লাখ থেকে সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া অনুদানের অর্থ কেটে রাখা হয়। আইএলওর নেতৃত্বে গঠিত ওই তহবিল সংক্রান্ত সব কার্যক্রম ওই দিনই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে গঠিত জাতীয় কমিটি ক্ষতিপূরণের একটি কাঠামো নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকরা প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি। প্রতি বছরই সাভারে রানা প্লাজা ধসের অস্থায়ী বেদি কিংবা জুরাইনে কবরস্থানে শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে এ নিয়ে আহাজারি করতে দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, শ্রমিকদের তালিকা ছিল না, তাদের নিয়োগপত্র কিংবা পরিচয়পত্র দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণের নামে যা পাওয়া গেছে, সেটা আসলে বিশেষ অনুদান। আইএলও, ব্র্যান্ড ক্রেতাদের এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেয়নি।
রাজধানীর অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ধসে এই ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন আড়াই হাজার শ্রমিক। এ দুর্ঘটনাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা মনে করা হয়।
আরো পড়ুন : সৌদিতে আজ ঈদুল ফিতর, কাল বাংলাদেশে হওয়ার সম্ভাবনা