নিজস্ব প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার হাজারো পরিবারের জমি আত্মসাৎ, হত্যা-গুম এবং নিরীহ মানুষদের অত্যাচারের পর এবার খোদ রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভয়ংকর প্রতারণা করেছেন রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। ব্যাংকের কাছে জমি বন্ধক রেখে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে সেই জমি আবার বিক্রি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে। অন্যদিকে একই জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়ার পর ছয় বছরে কিস্তির এক টাকাও পরিশোধ করেননি রফিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা মানে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা। এই ভয়ংকর কর্মকান্ডে যারা জড়িত রয়েছেন সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল পৃৃথক ছয়টি তফসিলভুক্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১২৬.৭৭ শতক জমি বন্ধক রেখে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) বসুন্ধরা শাখা থেকে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিক। যার বন্ধকী দলিল নম্বর ৩৯৮৪। তবে গত ছয় বছরে রফিকের কাছ থেকে একটি কিস্তিও আদায় করতে পারেনি সেই ব্যাংক। বর্তমানে ওই ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তবে পিলে চমকে ওঠা তথ্য হলো, বন্ধকী সেই জমির ১৬.৫ শতাংশ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে রফিক বিক্রি করে দিয়েছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কাছে। তথ্য গোপন করে ঢাকার ভাটারা থানার জোয়ারসাহারা মৌজার ওই জমি বিক্রি করে কৌশলে হাতিয়ে নেন ৮ কোটি ২১ লাখ ৬ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে সেই জমির নামজারি সম্পন্ন হয়েছেও ওই প্রতিষ্ঠানের নামে। জালিয়াতি করে বিক্রি করা সেই জমির সিএস ও এসএ ৩২৫৯, আরএস ৯৫৯৫ নম্বর দাগের ঢাকা সিটি জরিপ দাগ নম্বর ৩৮০০৭। তবে রংধনু রফিকের এ জালিয়াতির খবর ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।
বন্ধকী জমির তথ্য গোপন করে বিক্রি করার সুযোগ নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, বর্তমানে বন্ধকী সম্পত্তির বিবরণও সিবিআই রিপোর্টে যুক্ত করা হচ্ছে। যাতে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও জানতে পারে কোন জমি কার কাছে বন্ধক রয়েছে। ব্যাংকে বন্ধক রাখা জমি অন্যত্র বিক্রি করা হলে সেটা অবশ্যই গুরুতর অপরাধ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা অবস্থায় জমি অন্য পক্ষের কাছে বিক্রির সুযোগ নেই। যদি কেউ বিক্রি করে তবে তা প্রতারণা। কারণ, জমি বিক্রি করতে হলে অবশ্যই মূল দলিল সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে প্রদর্শন করতে হয়। এখানে দুটি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি হতে পারে। প্রথমত, ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতা পরস্পর সম্মিলিতভাবে এটি করতে পারে। এক্ষেত্রে হয়তো ব্যাংক মূল দলিল না রেখেই ঋণ প্রদান করেছে। যদি ব্যাংক যথাযথ প্রক্রিয়ায় ঋণ দেয় সেক্ষেত্রে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। কারণ এ সময় গ্রাহকের কাছে মূল দলিল থাকার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের সঙ্গে রফিকের এই ভয়ংকর প্র্রতারণার বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর বিস্ময় প্রকাশ করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন নিষ্পত্তি ছাড়া বন্ধকী জমি বিক্রির কোনো ধরনের সুযোগ নেই। যদি বিক্রি হয়, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই জালিয়াতি করা হয়েছে। এজন্য ভুক্তভোগীরা জমি বিক্রেতা বা লোনগ্রহীতার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে পারে। ব্যাংকে বন্ধক দেওয়া দলিলের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, বন্ধকী এই দলিলের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সম্মতি দেন রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ছেলে কাউসার আহমেদ অপু এবং মো. শফিক বিল্লাহ ভূঁইয়া। দলিলে কাউসার আহমেদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘এ’ ব্লকের ১২/ডি অ্যান্ড ই নম্বর বাড়ি। মো. শফিক বিল্লাহ ভূঁইয়ারও একই ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখার ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বলেন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে রংধনু গ্রুপের অনিয়ম তথ্য জানার পর আমরাও অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করি। তদন্তে এসআইবিএলের সঙ্গে রফিকের প্রতারণার বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। রফিক আমাদের শাখায় জমি বন্ধক রেখে তথ্য গোপন করে পুনরায় রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। কেবল ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নয়, এমন আরও বেশকিছু প্রতারণার তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্ধককৃত জমির ‘বি’ তফসিলের সাড়ে ১৬ শতাংশ জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দেন ওই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই ‘বি’ তফসিলেই ছিল বসুন্ধরা আবাসিকের আই-ব্লকের ৭৭ ও ৭৮ নম্বর প্লট। বর্তমানে ওই জমির ওপর নির্মিত হয়েছে ১০ তলাবিশিষ্ট বিল্ডিং, যা ‘বিজনেস পয়েন্ট’ বিল্ডিং নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। ওই ভবনেই রংধনু গ্রুপের রফিকের হেড অফিস রয়েছে। দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভূমি অফিসের বাড্ডা জোনের সাব-রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এ দলিল রেজিস্ট্রি হয়। যার দলিল নম্বর ১১৯৩৪, তারিখ-২০ ডিসেম্বর ২০১৮। নামজারি মামলা নম্বর ৮২০১/২০১৮-২০১৯। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৭৭ ও ৭৮ প্লটের জমিটি রাষ্ট্রীয় ওই প্রতিষ্ঠানের নামে নামজারি খতিয়ানভুক্ত হয়। যার নম্বর ৪৫০৩৭ ও জোত নম্বর ৫১/২৩০। ব্যাংকে বন্ধক থাকা জমি বিক্রি এবং নামজারি করে নেওয়ার বিষয়ে ক্যান্টনমেন্ট রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) জালাল উদ্দিন বলেন, ব্যাংকে বন্ধক থাকা অবস্থায় জমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। তারপরও এমনটি করে থাকলে অবশ্যই এটা জালিয়াতি।
খতিয়ানটিতে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় ক্যান্টনমেন্ট রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম, ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা শেখ শরীফুজ্জামান ও নাজির কাম ক্যাশিয়ার এস এম আরিফুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কর্মকর্তারা ওই নামজারি পত্রে স্বাক্ষর করেন।
আরো পড়ুন : হলফনামায় তথ্যমতে স্বপনের ৫ আর ছেলের সম্পদ বেড়েছে ২৮ গুণ