দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য রোড ফায়ার হাইড্র্যান্ট (অগ্নিনির্বাপণে রাস্তার পাশে স্থাপিত কৃত্রিম পানির উৎস) সবচেয়ে জরুরি হলেও রাজধানীর কোথাও তা নেই। ব্যক্তিগতভাবে দুয়েকজন ভবন মালিক বা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য ফায়ার হাইড্র্যান্টের ব্যবস্থা থাকলেও ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন বা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) রাজধানীর অন্য কোথাও কখনোই ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বড় ধরনের কোনো অগ্নিকাণ্ডে পানি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসও। পাশাপাশি রাজধানী থেকে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে– ফায়ার হাইড্র্যান্টও নেই, জলাধারও হারিয়ে যাচ্ছে, তাহলে আগুন নেভানো হবে কীভাবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, উন্নত দেশে সব সেবা প্রতিষ্ঠান মিউনিসিপ্যালিটির অধীনে থাকে। রাজউক-ওয়াসার মতো আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকে না। সিটি করপোরেশনের কার্যপরিধির মধ্যে ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপনের কোনো বিষয় নেই। এখানে পানি সরবরাহের জন্য ঢাকা ওয়াসার মতো পৃথক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কাজেই ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপনের দায়িত্বটি তাদের ওপরই বর্তায়। তারা ইচ্ছা করলে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা নিয়ে এটা স্থাপন করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় বড় অগ্নিকাণ্ডের পর রোড ফায়ার হাইড্র্যান্টের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
রোড ফায়ার হাইড্র্যান্ট হলো পানির একটি উৎস, যা নির্দিষ্ট দূরত্বে রাস্তার পাশে ভূগর্ভস্থ পানির পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত করে বসানো থাকে। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের হোসপাইপ ফায়ার হাইড্র্যান্টের সিপির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ফায়ার হাইড্র্যান্টের পানি দিয়ে অগ্নিনির্বাপণের কাজ করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফলে অগ্নিনির্বাপণ সহজ হয়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রোড ফায়ার হাইড্র্যান্ট তো নেই-ই, বিকল্প পানির জলাধারও নেই। আমরা দু’দিক দিয়েই বিপদে আছি। তাহলে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাবে কীভাবে? নিমতলী ট্র্যাজেডির পর রোড ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। পরে তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ কোনো সেবা সংস্থা নেয়নি।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক সমকালকে বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে রোড ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসানোর অনুরোধ ছিল। সেটা হয়নি। গুলশান-বনানীতে কিছু ভবন মালিক ব্যক্তিগতভাবে ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসিয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা শহরের আর কোথাও ফায়ার হাইড্র্যান্ট নেই। পানির পাইপলাইন বসানোর সময় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করে এটা করে ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও রাজউক হয়তো সহযোগিতা করবে। কিন্তু মূল দায়িত্বটা ওয়াসাকেই পালন করতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার মুখপাত্র মোস্তফা তারেক বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য ঢাকা শহরে এখনও ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসানো সম্ভব হয়নি। তবে এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ওয়াসার কথা হয়েছে। তাদের পাইপের মাপ অনুযায়ী সেটা বসাতে হবে। এ জন্য ওয়াসা সহযোগিতা করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
১৯৯৫ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছিল বঙ্গবাজার মার্কেট। তখনও আগুন নেভাতে পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। বঙ্গবাজার-সংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলের ভেতরের পুকুরে পাইপ লাগিয়ে পানি টেনে আগুন নেভাতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের গুলিস্তান মার্কেটে আগুন লাগে। তখনও একই অবস্থা হয়।
সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিলের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় শহিদুল্লাহ হলের পুকুর, ঢাকা ওয়াসার পানির গাড়ি এমনকি হাতিরঝিল থেকে সেনা ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে বাউজার বাকেট ও বাম্বি বাকেটে করে পানি নিয়ে ছিটানো হয়েছে অগ্নিকাণ্ডস্থলে। ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শত শত দোকান।
হারিয়ে যাচ্ছে জলাধার: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে গেছে। অথচ এসব জলাশয় প্রাথমিকভাবে অগ্নিনির্বাপণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সম্প্রতি গেজেট হওয়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাধারের পরিমাণ ১০ শতাংশেরও নিচে। যে জলাশয় আছে সেগুলোও সঠিক অবস্থায় নেই। কিন্তু আধুনিক শহরে ১৫ শতাংশ জলাধার থাকা প্রয়োজন। ড্যাপে ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ এলাকায় জলাধার রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, সিএস রেকর্ড অনুযায়ী রাজধানীতে ৫২৩টি পুকুর ছিল। এগুলো জলাধার হিসেবে কাজ করত। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস আসে তো পরে। আগে এই জলাধারগুলোই আগুন নেভানোয় প্রথম কাজে আসত। কিন্তু আমরা জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলেছি। বাস্তবে এখন গোটাপঞ্চাশেক পুকুর আছে। শহিদুল্লাহ হলের পুকুর না থাকলে এবার অবস্থা আরও ভয়াবহ হতো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি রোড হাইড্র্যান্টেরও ব্যবস্থা করতে হবে। জাপানে রাস্তার পাশে একটু ফাঁকা জায়গা থাকলে সেখানে জলাধার করা হয়। দুর্ঘটনার সময় সেই জলাধারের পানি প্রথমে ব্যবহৃত হয়।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমরা খাল-বিল, পুকুর ধ্বংস করছি। গত ৩০ বছরে যে পরিমাণ পুকুর-জলাশয় ভরাট করেছি, সেটা ভয়ংকর। বর্তমান পানি ভবনটির স্থানেও একসময় জলাশয় ছিল। রোকেয়া হলের পুকুর, ওসমানী উদ্যানের লেক ধ্বংস করা হয়েছে। ফায়ার হাইড্র্যান্ট থাকলেও আজ এই অবস্থা হতো না। ফায়ার হাইড্র্যান্ট থাকলেও জলাশয় যে লাগবে না, এমন নয়। জলাশয় থাকতেই হবে। ১৫ ভাগ জলাশয় আমাদের দরকার। কিন্তু খালগুলো বন্ধ করে আমরা রাস্তা বানিয়েছি। আমরা মনে করছি, রাস্তাই আমাদের বেশি প্রয়োজন।
আরো পড়ুন : বঙ্গবাজারের রাস্তার পাশে অস্থায়ী দোকানে ক্ষতি পোষানোর সংগ্রাম