স্টাফ রিপোর্টার : জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ঢাকায় জানাজা অনুষ্ঠানের দাবিকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। মঙ্গলবার ভোর রাতে এ ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জামায়াতের নেতাকর্মীদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে সাঈদীর লাশবাহী এম্বুলেন্স বের করে দেয়। পরে কড়া নিরাপত্তায় লাশবাহী গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুরে। সেখানে আল্লামা সাঈদী ফাউন্ডেশন মাঠে জানাজা শেষে সাঈদীর লাশ দাফন করা হয়।
সোমবার দিবাগত রাত ৮টা ৪০ মিনিটে আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুর পর হাসপাতালে আসতে থাকেন তার সমর্থকরা। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাউকে কাউকে আহাজারি করতে দেখা যায়। দলটির আইনজীবীরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। মানুষের চাপের কারণে হাসপাতালের আনসার সদস্যরা গেট বন্ধ করে দেন। রাতভর সেখানে উত্তেজানা বিরাজ করে।
রাত ১০টার দিকে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ সেখানে যান।
তিনি সব নেতাকর্মীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন যে, সাঈদী সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপর সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদী কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তার বাবার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার আবেদন করেন। এই আবেদনের পর লাশের ময়নাতদন্ত না করে একজন মাজিস্ট্রেটকে দিয়ে সুরতহাল করা হয়।
সুরতহালের পর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করেন কারা কর্তৃপক্ষ। রাতে হাসপাতালে আসেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এখানে যারা আজ কাঁদছেন এবং আহাজারি করছেন তারা কোরআনের পাখি সাঈদীকে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। মাওলানা সাঈদী অর্ধ শতাব্দী ধরে দেশে ও বিদেশে কোরআনের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি। জামায়াতে ইসলামীর সিদ্ধান্ত যে, তার একটি জানাজা ঢাকায় হবে। আরেকটি জানাজা হবে পিরোজপুরে। কারও কোনো কথায় কান না দিয়ে দলের সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানো হলো।’ তার বক্তব্যের পরেই পুলিশ জামায়াত নেতাকর্মীদের হাসপাতাল ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়। এ সময় জামায়াতের নেতাকর্মীরা লাশ না নিয়ে সেখান থেকে যাবেন না বলে ঘোষণা দেন। তারা ঢাকায় জানাজা করতে চান বলে জানান। তখন হাসপাতালের সিসিইউ এর গেটে অনেক নেতাকর্মী শুয়ে পড়েন।
দীর্ঘক্ষণ তারা সেখানে অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে পুলিশের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। লাশবাহী এম্বুলেন্সের সামনে অবস্থান নেন জামায়াত শিবির কর্মীরা। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে জামায়াতের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো হাসপাতাল এলাকা। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে হাসপাতাল ও শাহবাগ এলাকা ত্যাগ করে বিভিন্ন দিকে চলে যান। তখন সাঈদীর লাশবাহী এম্বুলেন্সটি ঠেলে বাইরে নিয়ে আসে পুলিশ। গাড়িটির চাকা পাংচার এবং সামনের কাঁচ ভেঙে যাওয়ায় অন্য একটি এম্বুলেন্স এনে সাঈদীর লাশ নিয়ে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া হয়। সংঘর্ষের সময় একটি মোটরসাইকেলেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় জামায়াত শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. রেজাউর রহমান জানান, হাসপাতালের অক্সিজেন প্লান্ট ও জানালার কাঁচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পিরোজপুরে সাঈদীর জানাজায় মানুষের ঢল
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল পিরোজপুর শহরে আল্লামা সাঈদী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে দুই দফা জানাজা শেষে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সেখানকার বায়তুল হামদ জামে মসজিদের পাশে তার দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় জামায়াত-শিবিরের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ছাড়াও সাঈদীর হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী অংশ নেন। এ সময় সাঈদীর বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকেও দেখা যায়। সাঈদীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি সাঈদী ফাউন্ডেশনে হাজির হন। এ সময় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেন। জানান, সাঈদী ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি এমপি থাকা সময় এলাকার সব মানুষ মায়ের পেটে থাকার মতো নিরাপদে ছিলেন।
এদিকে সাঈদীর জানাজাকে কেন্দ্র করে পিরোজপুর শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। মোতায়েন করা হয় পুলিশ, র্যাব, বিবিজি, আর্মড পুলিশ। এর আগে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর লাশবাহী এম্বুলেন্স পুলিশি পাহারায় পিরোজপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত সাঈদী ফাউন্ডেশন মাঠে পৌঁছায়। সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী ঢাকা থেকে পিরোজপুরে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় জানাজা দুপুর সোয়া ১টার দিকে শুরু হয়। জানাজায় ইমামতি করেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির প্রফেসর মুজিবুর রহমান। জানাজার পূর্বে তিনি ও সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মুজিবুর রহমান বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনে সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদীকে জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণা করে সবার ভোট চান। দুপুর ২টার দিকে সাঈদীর মেজো ছেলে শামীম বিন সাঈদী পিরোজপুরে পৌঁছান।
পিতার অসুস্থতার খবর শুনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন। পরে তার উপস্থিতিতে বেলা ৩টার দিকে দ্বিতীয় দফা জানাজা হয়। এরপর বেলা সাড়ে ৩টায় আল্লামা সাঈদী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে অবস্থতি বায়তুল হামদ জামে মসজিদের পাশে জামায়াতে ইসলামীর এ শীর্ষ নেতাকে বড় ছেলে মাওলানা রাফীক বিন সাঈদীর পাশে দাফন করা হয়। এর আগে সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। গত রোববার বিকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত সাঈদীকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে ওই রাতেই তাকে বিএসএমএমইউয়ে নেয়া হয়। সাঈদীর মৃত্যুর খবরে বিএসএমএমইউতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও তার ভক্তরা ভিড় জমায়। এ সময় সাঈদীর জানাজার স্থান নির্ধারণ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নেতাকর্মীরা ঢাকায় সাঈদীর জানাজা অনুষ্ঠানের দাবি করলেও প্রশাসনের আপত্তিতে সেটি করতে পারেনি পরিবার।
আরো পড়ুন: সাম্প্রতিক সময়ে অজ্ঞানপার্টির প্রাণঘাতী হালুয়া যেন নয়া আতঙ্ক