শব্দদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান শীর্ষে

আন্তর্জাতিক ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ জাতীয় প্রচ্ছদ মুক্তমত স্বাস্থ্য কথা হ্যালোআড্ডা

শব্দদূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর একটি ঢাকা। এই মেগাসিটিতে সড়কের প্রধান পয়েন্টগুলোতে বিভিন্ন যানবাহনের অপ্রয়োজনীয় হর্নের শব্দে কান পাতা দায়। এর সঙ্গে নির্মাণকাজ যেমন- ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, টাইলস কাটার মেশিন, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ এবং মাইকের শব্দের কারণে গোটা শহরজুড়ে চলছে এক ধরনের শব্দসন্ত্রাস। অনাকাক্সিক্ষত শব্দদূষণের কারণে ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া মানুষজনও এখন আর স্বস্তিতে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় মানুষের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাইপারটেনশন, আলসার, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা এবং কাজে মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

গবেষণা বলছে, আগে রাজধানীতে গড়ে ১২ ঘণ্টা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দদূষণ হতো। এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। ক্যাপস কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৫টি স্থান। গবেষণায় তাইওয়ানের তৈরি স্বয়ংক্রিয় শব্দের মাত্রা পরিমাপক যন্ত্র অটোমেটিক সাউন্ড লেভেল মিটার ব্যবহার করা হয়।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান (সর্বোচ্চ সীমা) ৬০ ডেসিবেল। কিন্তু এ গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া যায়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে সেগুেেলা হলো- নিউমার্কেট মোড়, নয়াপল্টন এবং প্রেস ক্লাব মোড়। এসব জায়গায় শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০ দশমিক ৬৫ ডেসিবেল, ৯২ দশমিক ২২ ডেসিবেল এবং ৯০ দশমিক শূন্য ৩ ডেসিবেল। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মোড় (৯৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবেল), শিয়া মসজিদ মোড় (৯৩ দশমিক শূন্য ৫ ডেসিবেল) এবং মাসকট প্লাজা মোড় (৯০ দশমিক ২৭ ডেসিবেল)।

ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমরা ঢাকায় প্রতি বছর ৭০টি স্থানে শব্দের মান পরিমাপ করে থাকি। এসব স্থানে দিনে ও রাতে কোথাও নির্ধারিত মানমাত্রা পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ শব্দ পাওয়া যায়। যানবাহন ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্প, গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজ থেকে শব্দদূষণ হচ্ছে। আর বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো থেকেও অত্যাধিক শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে বর্ষ উদযাপনও শব্দদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। সাকরাইন, শবেবরাত, অনান্য ধর্মীয় উৎসবে বাজি ও আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে ৩১ ডিসেম্বরে বর্ষবরণ উদযাপনে শব্দের দূষণ বেশি হয়।

মিরপুর কাজীপাড়ায় ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার রাতে নিজের প্রাইভেট কার চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন চিকিৎসক হাসান শিকদার। সড়কে তখন যানবাহনের চাপ খুব বেশি না থাকলেও হাসানের ঠিক পিছনেই ওভারটেকিং করার জন্য একটি পিকআপ টানা হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে হাসান সেই পিকআপ চালককে সাইডে গাড়ি থামাতে বলেন এবং অপ্রয়োজনে হর্ন দেওয়ার কারণ জানতে চান। সেই পিকআপ চালক উল্টো হাসানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলেন, ‘আমার হর্ন আমি যতবার ইচ্ছা দেব, আপনার কী!’

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) সর্বশেষ প্রতিবেদন ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসমেসেস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। কিন্তু ঢাকার শব্দের মাত্রা সেখানে ১১৯ ডেসিবেল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘গাড়ির শব্দ, উড়োজাহাজ চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপাতি, শিল্প এবং বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজনের শব্দদূষণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পরিবেশ অধিদফতরেরও এক জরিপে জানা যায়, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তারা তো বধিরতায় আক্রান্ত হবেই, পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাইপারটেনশন, আলসার, স্মরণশক্তি হ্রাস, ¯œায়ুর সমস্যা এবং কাজে মনোযোগী হতে না পারার সমস্যায় ভুগতে পারেন।

‘নয়েজ পলিউশন ইন ঢাকা : কারেন্ট সিচুয়েশন অ্যান্ড সাজেশনস ফর অ্যাকশন’ শীর্ষক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ৬৯ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে মাথাব্যথায় ভোগে। ৬৮ শতাংশ এ জন্য উত্তেজনা বোধ করে। ৪৯ শতাংশের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ৪৩ শতাংশের মনোযোগে সমস্যা হয়। ৪২ শতাংশের শ্রবণে সমস্যা হয়। ৪২ শতাংশের হৃদরোগের সমস্যা হয়। ৩৯ শতাংশের ঘুমের সমস্যা হয়। ৩৫ শতাংশ শিশুর বিকাশে সমস্যা হয়। শব্দদূষণে নারীদের পুরুষের চেয়ে বেশি সমস্যা হয়।

নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, শব্দদূষণ শুধু কানের ক্ষতিই করে না। এটি মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিও করে। অতিরিক্ত শব্দের জন্য কানের শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিকট শব্দের জন্য কানের পর্দাও ফেটে যেতে পারে। এমনকি অন্তঃকর্নেও অনেক সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। রাতে নির্মাণকাজের জন্য সৃষ্ট শব্দদূষণেও মানুুষ ঘুমাতে পারে না। আর রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানুষ দিনে সুস্থভাবে কাজ করতে পারবে না। এতে ঝিমুনি থাকবে, কাজে মনোযোগ কমে যাবে।

আরো পড়ুন : গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *