* শহরের অচেনা মাদক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পরায় ধ্বংসের পথে এক প্রজন্ম
*দেড় দশকে শুধু সাত ধরনের প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার মাদক উদ্ধার
দেড় যুগ আগেও অপিয়াম, কোকেন, এলএসডি, ব্রাউনি, আইস, এমডিএমএ-এই মাদক দেশের মানুষের কাছে অনেকটা অচেনা ছিল। আর এখন এই নামগুলো মাদকসেবীদের মুখে মুখে। দেশের বহুল প্রচলিত গাঁজা, মদ, ইয়াবা, ইনজেকটিং ড্রাগের সেবনকারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন মাদকের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। জীনবঘাতী এসব নেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারী-শিশুদের আসক্তিও বেড়েই চলছে। এক সময়ের শহরের মাদক এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়েছে। গত দেড় দশকে দেশের শনাক্ত ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে শুধু সাত রকমের যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। তবে উদ্ধার হওয়া এই মাদক দেশে ছড়িয়ে পড়া মোট মাদকের ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয় বলে মত সংশ্লিষ্টদের। সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী ও শিশুদের মধ্যে মাদকাসক্তি। এমন পরিস্থিতিতে মাদক নির্মূলে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে।
মাদক প্রতিরোধে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো বলছে, বাংলাদেশ এখন মাদকের ট্রানজিট রুট। আকাশপথ, স্থলপথ এবং সীমিত পরিসরে জলপথেও দেশে মাদক ঢুকছে। আন্তর্জাতিক মাদক চক্র বাংলাদেশকে এখন ‘সেফ রুট’ হিসাবে ব্যবহার করছে। দেশে মাদক বিস্তারের এটিও বড় কারণ। বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ২ কোটির মতো। এর মধ্যে দেড় কোটি নিয়মিত এবং ৫০ লাখ অনিয়মিত। দেশে মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। প্রতিবছরই এই সংখ্যা বাড়ছে। মাদক লেনদেনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। মাদকের সর্বনাশা থাবায় ধ্বংসের পথে একটি প্রজন্ম। এটি আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ অবস্থা মোকাবিলায় কাজ না করতে পারলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, পুরাতন মাদকগুলোর পাশাপাশি নতুন অনেক মাদকও দেশে আসছে। আগে থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ এ অঞ্চলের প্রচলিত মাদকগুলো এখন আমাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এভাবে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও আসছে। এখানে ডার্ক ওয়েব ও বিটকয়েনের ব্যবহারও হচ্ছে। নতুন মাদকের মধ্যে ‘আইস’ সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা হতে পারে। আর মাদক এমডিএমএ প্রধানত ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যবহার হয়। এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকটা এলএসডির মতোই। এভাবে প্রতিটি মাদকই মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য অনুযায়ী, এখন মাদক ব্যবসায় জড়িত আছে ২০০ গডফাদার ও ১ লাখ ৬৫ হাজার বিক্রির নেটওয়ার্ক। এদের মাধ্যমে মাদক খাতে বছরে লেনদেন হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর বেশকিছু সংস্থার তথ্যানুযায়ী অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাদক কারবারিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক এলাকায় মাদক কারবারিরা সাধারণ মানুষের কাছেও পরিচিত। এজন্য মাঝেমধ্যে তারা গ্রেফতারও হন। কিন্তু কিছুদিন পর বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাদের দায়েরকৃত মামলায় ৫২ শতাংশের বেশি আসামি খালাস পেয়েছেন। এ অবস্থায় মাদক মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, আমরা বেশিরভাগ সময় মাদকের ক্যারিয়ার (বাহক) ধরি। গডফাদাররা অধিকাংশ সময় আড়ালে থাকেন। এ কারণে ক্যারিয়ার ধরা পড়লে তারা নতুন কাউকে মাদক পরিবহণে নিয়োগ দেন। এজন্য সমন্বিতভাবে গডফাদারদের ধরতে কাজ করতে হবে। আরেকটা সমস্যা হলো মাদকের চাহিদা। এটি বন্ধ করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট থেকেই সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর গত ১৫ বছরের (২০০৯-২০২৩) উদ্ধারকৃত মাদকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংস্থাগুলো হলো-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। এ পর্যন্ত দেশে উদ্ধার হওয়া প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে এই পাঁচ সংস্থা সবচেয়ে বেশি উদ্ধার করে ৯ ধরনের মাদক। মাদকদ্রব্যগুলো হলো-ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ, বিয়ার ও ইনজেকটিং ড্রাগ। এর মধ্যে মদ ও বিয়ার ছাড়া বাকি সাত ধরনের মাদকের গত ১৫ বছরের উদ্ধারের পূর্ণ হিসাব পাওয়া গেছে। দেড় দশকে শুধু এই সাত ধরনের উদ্ধারকৃত মাদকের মূল্য দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৯৩২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬৫ টাকা।
এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণে চোলাই, জাওয়া, বাখার, তাড়ি, পাচুই, দেশি মদ, রেকটিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট উদ্ধার হয়েছে। দেশে আরও যেসব নেশাদ্রব্য উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে আছে-ট্যাবলেট (কোডিনাল/ডায়াজিপাম), এমফিটামিন, টলুইন, অ্যাসিটোন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, অপিয়েড মিশ্রিত পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, খাট, ট্যাপেন্টাডল এবং ড্যান্ডি ও নেশা জাতীয় গাম।
গত ১৫ বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪৪ পিস। যার প্রতি পিসের মূল্য ৩৫০ টাকা ধরলে এ অর্থের পরিমাণ হয় ১২ হাজার ৭৭৪ কোটি ৭৭ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ টাকা। হেরোইন উদ্ধার হয় ৪ হাজার ২৫ কেজি। হেরোইন গড়ে ১৭ লাখ টাকা কেজি ধরলে এর আর্থিক মূল্য হয় ৬৮৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। দেড় দশকে কোকেন উদ্ধার হয় ৬৪.৮১৩ কেজি। কেজি ১৭ কোটি টাকা ধরলেও উদ্ধারকৃত কোকেনের আর্থিক মূল্য এক হাজার ১০১ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার টাকা। এই সময়ে মোট আফিম উদ্ধার হয়েছে ৩৪৮.২৩৯ কেজি। ৮৫ হাজার টাকা কেজি ধরলে উদ্ধারকৃত আফিমের দাম ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪ হাজার ৯০৫ টাকা। গাঁজা উদ্ধার হয়েছে ৮ লাখ ৬১ হাজার ১১২ কেজি। গাঁজার কেজি ১৩ হাজার টাকা ধরলে এর মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ১১৯ কোটি ৪৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
দেড় দশকে ফেনসিডিল উদ্ধার হয় ১ কোটি ২৭ লাখ ৮ হাজার ৬৮৩ বোতল। ফেনসিডিলের প্রতি বোতলের দাম আড়াই হাজার ধরলে উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ১৭৭ কোটি ১৭ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। বোতলের বাইরে ২২ হাজার ৯০৫ লিটারেরও বেশি ফেনসিডিল উদ্ধার হয়। প্রতি লিটার ফেনসিডিল ২৫ হাজার টাকা হলে উদ্ধারকৃত দ্রব্যের আর্থিক মূল্য ৫৭ কোটি ২৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা। এই সময়ে ইনজেকটিং ড্রাগ (অ্যাম্পুল) উদ্ধার হয় ১৯ লাখ ১১ হাজার ৯৭৭টি। উদ্ধার হওয়া ইনজেকটিং ড্রাগের অ্যাম্পুল ৮০ টাকা করে হলেও এর দাম ১৫ কোটি ২৯ লাখ ৫৮ হাজার ১৬০ টাকা। মোট হিসাবে দেড় দশকে শুধু এই সাত ধরনের উদ্ধারকৃত মাদকের মূল্য দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৯৩২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৬৫ টাকা।
মাদকের অর্থের জোগানের বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার (আমিক)। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অভিভাবকের অর্থে মাদক কেনে। ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করে নিজের অর্থ। পরিবারের সম্পদ বিক্রি করে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যের টাকা চুরি করে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাদক কেনে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ব্যক্তি। প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের হেলথ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, এক ব্যক্তি একাধিক উৎস থেকেও মাদকের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। অর্থের জোগানে ভয়ংকর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে মাদকসেবীরা।
মাদকাসক্তদের শ্রেণির বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় এ ধরনের রোগীদের থেকে। এতে দেখা যায়-নারী ও শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৮০৭ নারী ও শিশু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এরমধ্যে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নারী ও শিশু রোগীর সংখ্যা ছিল শূন্য। ১৯৯৮ সালে এ সংখ্যা ছিল তিনজন। ১৯৯৯ সালেও ছিল তিনজন। পরের বছর এই সংখ্যা হয় পাঁচজন। ২০১৯ সাল থেকে ক্রমশই এ সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা হয় ৫৪৪, ২০২০ সালে এক হাজার ২৪২, ২০২১ সালে ১ হাজার ৭৬, ২০২২ সালে ৬৫৮ এবং সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু মাদকাসক্ত রোগী ছিল ৮০৭ জন। এর বাইরে বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী মাদকসেবী বাড়ায় এ ধরনের রোগীও বেড়েছে।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, সেবনকারীরা অর্থ জোগাড়ে এক সময়ে মাদক ব্যবসা করছে। এভাবে ক্রমশই এর চাহিদা বাড়ছে ও বিস্তার হচ্ছে। একজন মাদকাসক্ত দুই বছরে আরও পাঁচজন তৈরি করছে। মাদকের মাধ্যমে শুধু টাকা পাচার হচ্ছে তা নয়। মাদক হচ্ছে অপরাধের জনক। ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানিসহ যত রকমের অপরাধ হয় সবকিছুর মূলেই এই মাদক। তিনি আরও বলেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’র কথা বলছে। কখনো কখনো ঘোষণা দিয়ে মাদক নির্মূলে মাঠে নামছে। তবে লেগে থাকছে না। ফলে বেশিরভাগ সময়েই গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় সীমান্ত এলাকা এবং এয়ারপোর্টগুলোতে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানকারীদের রুট হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য দেশের প্রবেশপথগুলোতে মাদক শনাক্ত করার উপযোগী ‘ডগ স্কোয়াড’ মোতায়েন জরুরি।
আরো পড়ুন : গাজায় দুর্ভিক্ষের চরম সীমা অতিক্রম করছে, পশু-পাখির খাবার খাচ্ছে মানুষ