ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করা হয়েছে।
আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়। ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ শিরোনামে ব্যানারে এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ১৮ জুন শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরান মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি৷ স্বপন কুমার বিশ্বাস ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। সমাবেশে অংশ নিয়ে শিক্ষক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলেছেন, শিক্ষকের গলায় জুতার মালা বাংলাদেশের গলায়ই জুতার মালা।
সমাবেশে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান কাবেরী গায়েন বলেন, ‘নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোকে যদি আমরা নিজেদের গলায় জুতার মালা পরানো মনে না করি, তাহলে আমি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখি না৷ আমাদের শিক্ষক সমিতি, শিক্ষক ফেডারেশন, স্কুল ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, শিক্ষামন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের কাজটা আসলে কী? এ রকম করে কি এক এক করে শিক্ষকদের অপমান চলতেই থাকবে? শিক্ষক লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় উপনীত হয়েছে৷ সাভারে একজন শিক্ষককে সবার সামনে পিটিয়ে মারা হয়েছে৷ এসবের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের রুখে দাঁড়াতে হবে৷ শিক্ষক হত্যা-নিপীড়নের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি৷’
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী রাষ্ট্র বারবার মার খাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাবির গণযোগাযোগ সাংবাদিকতার অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস৷ তিনি বলেন, স্বপন কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ বাংলাদেশকে একটা ধর্মতাত্ত্বিক মনোলিথিক রাষ্ট্র বানানো হচ্ছে, যেখানে শুধু এক ধর্মের মানুষ বসবাস করবে৷ দুর্গাপূজার সময় অসংখ্য মণ্ডপে হামলা হয়েছে৷ কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন৷ এই অস্বীকৃতির রাজনীতি দেশের সনাতন বা অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তার ঝুঁকিকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়৷ একটি ঘটনারও বিচার হচ্ছে না৷
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়া আমাদের ক্রমাগত গ্রাস করছে৷ আফগানিস্তান আমাদের ঘাড়ের পাশে শ্বাস ফেলছে৷ এগুলো মেনে নিলে পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেলের ক্যামোফ্লেজের ভেতরে রাষ্ট্র ধর্মান্ধ ও চূড়ান্ত সম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে৷’
ঢাবির একই বিভাগের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর ভিডিও ক্লিপটি দেখে আমি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়ি৷ মনে হয়েছে, এই জুতা যেন আমাকেই পরানো হয়েছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এ ঘটনায় কোনো বিবৃতি দেয়নি৷ এতে বোঝা যায়, তারা এ ঘটনা পাশ কাটাতে চায় বা তারা দলান্ধ৷ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই৷ সেই সঙ্গে নড়াইলের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় থানার ওসিসহ ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করতে হবে৷ বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের শাস্তি দিতে হবে৷’
সমাবেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার শিক্ষক কামাল উদ্দিন কবির বলেন, ‘এই জঘন্য ঘটনা ও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অমুসলিম শিক্ষকদের ধর্মের নামে আঘাত করা হচ্ছে৷ এই ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে৷ তা না হলে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতেই পারি না৷ দ্রুত সব শিক্ষক ও পেশাজীবীদের সক্রিয়তায় সাম্প্রদায়িক দুষ্টচক্রকে রুখে দিতে হবে৷’
আজকের বাংলাদেশে পুলিশ, রাষ্ট্র ও সরকার একজন শিক্ষককে নিরাপত্তা দিতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের সংগঠক রবীন আহসান৷
তিনি বলেন, ‘যে পুলিশ আমাদের করের টাকায় চলে, সেই পুলিশ পাহারা দিয়ে একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে বের করে নিয়ে এসেছে৷ ওই শিক্ষক নিজে বাঁচার জন্য ও তাঁর ছাত্রদের রক্ষা করার জন্য নিজেই পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন৷ নড়াইলের এ ঘটনা আমাদের ব্যথিত ও চিন্তিত করেছে৷ এই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ৷ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা হচ্ছে বাংলাদেশের গলায় জুতার মালা৷ এই জুতার মালা বাংলাদেশের মানচিত্রের গায়েই পড়েছে৷ এমন একটি ঘটনায় দেশের শিক্ষক ও ছাত্ররা চুপচাপ৷ এমন হতভাগ্য বাংলাদেশ আমি আমার জন্মের ৪৯ বছরে দেখিনি৷ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের জোয়ার চলছে, কিন্তু মানুষের মননের উন্নয়ন একদম নিম্ন পর্যায়ে৷ এই উন্নয়ন দিয়ে দেশ আর চলবে না৷’
নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের অন্যতম সংগঠক আকরামুল হকের সভাপতিত্বে ও আরেক সংগঠক খান আসাদুজ্জামানের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান ও লাকী আক্তার, শিক্ষক ঐক্য পরিষদের নেতা রণজিত দেব, ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতা কাজল দেবনাথ, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত প্রমুখ বক্তব্য দেন৷
প্রসঙ্গত, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাময়িক বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নড়াইল সদরের এক কলেজছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ১৮ জুন কলেজের অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়৷ স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ওই ছাত্র ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাঁকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন৷ ওই সময় অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের ‘পক্ষ নিয়েছেন’ এমন রটনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হয়৷
এ সময় উত্তেজিত ছাত্ররা অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন৷ খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁদেরও সংঘর্ষ বাধে। এ সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের কিছু ছাত্র ও স্থানীয় ব্যক্তিরা পুলিশের উপস্থিতিতে স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন৷
আরো পড়ুন : অস্ট্রেলিয়ার ধর্ষণ আইন বদলে যাচ্ছে মুলিনসের হাত ধরে