সিট ফাঁকা নেই। রাজধানীর শিশু হাসপাতালের। সাধারণ ওয়ার্ডেও চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। এ অবস্থায় চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে ছুটছেন স্বজনরা। আক্রান্ত রোগীদের বয়স ৬ মাস থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত। তবে ৫ থেকে ১০ বছরের শিশুরা বেশি আক্রান্ত। হাসপাতালের তথ্যমতে, শয্যা খালি না থাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। তাতে ৪০ থেকে ৪২টি শয্যা রয়েছে। বর্তমানে ১১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি রয়েছে।
গতকাল হাসপাতালটিতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে ছোটাছুটি করছেন স্বজনরা। হাসপাতালজুড়ে শিশুদের চিৎকার। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিগি-বিদিক ছুটছেন স্বজনরা। ওয়ার্ডে ভর্তি শিশুদের মলিন মুখ ও স্বজনদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে শূন্য, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ১১ জন, মে মাসে ১৫ জন, জুনে ৬৩ জন, জুলাই মাসে ৩০০ জন। চলতি বছরের সাত মাসে ৩৯৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে ৭ জন। এরমধ্যে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে হাসপাতালটিতে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে ১ বছরের কম বয়সী রোগী ভর্তি ছিল ৫৪ জন, ১ থেকে ৫ বছরের ১২৯ জন, ৫ থেকে ১০ বছরের ১৩৮ জন, ১০ বছরের উপরে ৭৮ জন। তারমধ্যে ১৪৯ জন ছেলে ও ২৫০ জন মেয়ে। বর্তমানে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১০ জন।
৪ বছরের শিশু সুমাইয়ার মায়ের সঙ্গে। মা আঁখি আক্তার বলেন, ৭ তারিখ থেকে মেয়ের জ্বর আসে। এরপর জ্বর কমে যায়। এক সপ্তাহ ধরে শরীরে কোনো জ্বর ছিল না। এরপর আবার জ্বর আসে। তখন ডাক্তারের কাছে নিলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে বলে ও সঙ্গে কিছু মেডিসিন দিয়ে দেয়। পরে পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। এরপর আবার ১৫ তারিখে পরীক্ষা করানো হয়। তখন দেখি রক্তের প্লাটিলেট একেবারে কমে গেছে। তখন রাত ১টার দিকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু খেতে চাচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৭ বছর বয়সী আলিফা। তার মা কাকলি আক্তার বলেন, তার স্বামী গার্মেন্টসে চাকরি করে। মেয়ে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। এলাকায় অনেক মশা। কয়েল দিনে রাতে সবসময় জ্বালিয়ে রাখি। ঘুমালে মশারিও দেয়া হয়। কিন্তু কীভাবে ডেঙ্গু জ্বর হলো বুঝতেছি না। চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। কিছুই খেতে চায় না। ওর বাবা অল্প বেতনে চাকরি করে। মাত্র ২ হাজার টাকার মেডিসিন নিয়ে এসেছে। শুধু সিট ভাড়াই দিতে হয়েছে ১৭০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে মেয়ের চিকিৎসা করানো কষ্টকর। একটু সুস্থ মনে হলে বাসায় নিয়ে যাবো। না হলে থাকা সম্ভব হবে না। বাসা ভাড়া, নিত্যপণ্যের দাম যে পরিমাণ বাড়তি তাতে চলা মুশকিল। এখানে বললাম সিট ভাড়া একটু কমিয়ে রাখতে কিন্তু শুনেনি। সবার কি আর এক রকম সামর্থ্য আছে।
৪ দিন ধরে জ্বর ৬ মাস বয়সী রুফাইদার। ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বেডে ভর্তি। তার মা রুমানা বলেন, মোহাম্মদপুরে বাড়ি। বাসার আশেপাশে অনেক মশা। এতো ছোট বাচ্চাকে কীভাবে মশায় কামড়িয়েছে বুঝতে পারছি না। অনেক খেয়াল করে রাখা হয়। জ্বর এসেছে বুঝে একদিন পরেই হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে পপুলার হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করে পজেটিভ আসে। এখন জ্বর কমলেও শরীর অনেক দুর্বল। কিছুই খেতে চাচ্ছে না। এতো ছোট বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে কষ্টের শেষ নেই।
হাসপাতালটির ডেঙ্গু কর্নারের কর্তব্যরত নার্স জানান, শয্যা খালি নেই। আগের মতোই রোগীর চাপ রয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে রোগী আসছে। অন্যান্য সাধারণ ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগী রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তবে প্রথম দিকের তুলনায় মানুষ এখন একটু বেশি সচেতন হয়েছে। জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসছে। আমরা তাদের অবস্থা বুঝে হাসপাতালে ভর্তি বা পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। এর আগে যে রোগীগুলো আসতো তারা অধিকাংশই শকে চলে যেতো। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ডাক্তারের বেগ পেতে হতো। এখানে ডেঙ্গু কর্নারে দুইটা ওয়ার্ড রয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৯ জন। বর্তমানে ১১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি রয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চলতি বছরের গত দুই মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে ৩০০ জনই শুধু জুলাই মাসে ভর্তি হয়েছে। আমাদের এখানে বেডের খুবই সংকট। অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৮৯ জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া খুবই কঠিন। তারপরও আমাদের চিকিৎসক-নার্সসহ সবাই বেশ তৎপর। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আমাদের স্পেশাল ডেডিকেটেড চিকিৎসক বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত সিরিয়াস রোগীদের জন্য দু-একটি স্পেশাল শয্যা সব সময় খালি রাখতে বলা হয়েছে। কোনো সিরিয়াস ডেঙ্গু রোগী আসলে যেন তাদের ফিরে যেতে না হয়। আগামী দিনগুলোতে বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলে আরও শয্যা ডেডিকেটেড করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
আরো পড়ুন : বয়স কমানোর চিকিৎসায় হতে পারে হিতে বিপরীত