ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণ করেই ক্ষান্ত হয়নি; পুলিশের প্রতিটি স্তরে বাসা বাঁধা অনিয়ম-দুর্নীতিতেও ছিল তাদের নীরব সমর্থন। পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে লাগামহীন দুর্নীতি হয় এ সময়কালে; অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় পুলিশ পদককেও দলীয় পদকে পরিণত করা হয়। এমনকি ভিন্নমত দমনে এবং ‘রাতের ভোটের’ জন্যও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিপিএম, পিপিএম, বিপিএম সেবা ও পিপিএম সেবা পদক দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকারপ্রধান নিজেই পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে পদকপ্রাপ্তদের এসব পদক পরিয়ে দেন। এর বাইরে বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত তালিকাভুক্ত পুলিশ সদস্যদের পুরস্কার হিসেবে পদক ও রিবন প্রদান করা হয়। ক্ষমতার পালাবদলের পর এসব পদক প্রদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্তসাপেক্ষে পদকপ্রাপ্তদের পদক কেড়ে নেওয়ারও দাবি করছেন কেউ কেউ।
পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বীরত্বপূর্ণ ও অসীম সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য প্রথমে সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে পুলিশ সদর দপ্তর। সেই আবেদন যাচাই-বাছাই করে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি কমিটি। পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) তা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় তা সরকারপ্রধানের অনুমোদন নিতে পদকের তালিকাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অনুমোদনের পরই এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। ২০২৪ সালে পুলিশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪শ জনকে পদক দেওয়া হয়। এর আগে কখনো বাংলাদেশ পুলিশে এত পদক দেওয়া হয়নি। ঢালাও রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ৪শ জনকে পুলিশ পদক দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি এইচআরএম কাজী জিয়াউদ্দিন। এরপরই পুলিশ পদক ২০২৩ প্রস্তাব
যাচাই-বাছাইকরণ কমিটির সদস্যপদ থেকে গত ২১ জানুয়ারি কাজী জিয়াউদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে কমিটির সদস্য করা হয় ‘দলদাস’ কর্মকর্তা ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামকে।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৩৪৯ জনকে পুলিশ পদক দেওয়া হয়। এটা ছিল পুলিশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ পদক দেওয়ার ঘটনা। পুলিশ পদকের বছরওয়ারি হিসাবে দেখা গেছে- ২০২৩ সালে ১১৭ জন, ২০২২ সালে ১১৫, ২০২১ সালে ১১৫, ২০২০ সালে ১১৮, ২০১৯ সালে ৩৪৯, ২০১৮ সালে ১৮২, ২০১৭ সালে ১৩২, ২০১৬ সালে ১১৫, ২০১৫ সালে ৮৬ এবং ২০১৪ সালে ১০৫ জন পুলিশ সদস্য চার ক্যাটাগরিতে পুলিশ পদক পান।
পুলিশ সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে পুলিশ পদক ধাপে ধাপে দলীয় পদকে পরিণত হয়। অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এক সময় শুধু মাঠ পুলিশে কর্মরত কনস্টেবল, এএসআই, এসআই, সার্জেন্ট, হাবিলদার ও ইন্সপেক্টররা এই রাষ্ট্রীয় পদক পেতেন। ২০১০ সালের পর থেকে পুলিশ পদকের বেশিরভাগ চলে যায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের কব্জায়। মোট পদকের সিংহভাগই তারা নিয়ে নেন। এর ফলে পদকপ্রাপ্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েও মাঠ পুলিশের সদস্যরা বঞ্চিত হন রাষ্ট্রীয় এই পদক থেকে।
পুলিশ পদক দলীয়করণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ আমাদের সময়কে বলেন, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ এবং ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ পদক দেওয়া হয়। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভালো কাজ করেছেন, তারা কম পদক পেয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক তদবিরেই বেশি পদক দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা পদক পাওয়ার যোগ্য, তারাই বঞ্চিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে এ ঘটনা না হয়, সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। শুধু পদক নয়, পদায়ন ও পদোন্নতিতেও বিগত বছরগুলোয় ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ফলে যারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন, বলেন তিনি।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৪ জন এমপি বিনাভোটে নির্বাচিত হন। অন্য আসনগুলোতেও নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে যাননি সাধারণ মানুষ। বিজিবি-র্যাব-পুলিশের পাহারায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকায় সিল মেরে দেখিয়েছিল যে, জনগণ ভোট দিয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে ভোটের আগের রাতেই প্রতিটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের পাহারায় নৌকায় সিল মেরেছে। এমনকি কোনো কোনো জায়গায় পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই সিল মেরেছে বলে তখন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করেছিল। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের পুরস্কার হিসেবে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) শেখ হাসিনার সরকার পুলিশ পদক প্রদান করে। এমনকি পুলিশের বিভিন্ন রেঞ্জ ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদেরও পুলিশ পদক দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের রাতের ভোটের জন্য র্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়নের অধিনায়কদেরও পুলিশ পদক প্রদান করা হয়।
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. আবদুল বাতেনকে ২০২৪ সালের পুলিশ সপ্তাহে বিপিএম সেবা পদক দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত পুলিশের প্রকাশনায় বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল প্রচেষ্টা চালায়। এ সময় রেঞ্জ ডিআইজি বাতেনের নেতৃত্বে রেঞ্জ পুলিশ সরাসরি ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে নাশকতার সব পরিকল্পনা বানচাল করেন। একই বছর বিপিএম পদক পান পুলিশ সদর দপ্তরের উপকমিশনার মো. আবু ইউসুফ। গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও সমমনা দলের মহাসমাবেশ ঘিরে জানমালের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষায় নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম তদারকি করায় তিনি এ পুরস্কার পান। একই বছর বিপিএম-সেবা পদক পান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকালে আশুলিয়ায় বিকাশ পরিবহনে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ঢাকা জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়কসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় তাকে এ পদক দেওয়া হয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখার যুক্তিতে। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করার ঘটনাতেও পুলিশ পদক দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামকে ছত্রভঙ্গ করার ঘটনাতেও পুলিশ ও র্যাবের একাধিক কর্মকর্তাকে পুলিশ পদক দেওয়া হয়। এভাবে ভিন্নমত দমনে ভূমিকা রাখায় শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ে পুলিশ পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেন, অভিযোগ খোদ পুলিশের।
আরো পড়ুন : দীপ্তি চৌধুরীকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ প্রসঙ্গে যা বললেন বিচারপতি মানিক