শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি কমাতে পাড়লেও বাংলাদেশে পারছে না কেন?

অর্থনীতি আন্তর্জাতিক জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি উল্টো বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি প্রশমনে মোটা দাগে তিন পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এগুলো হলো- বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, সুদহার বাড়ানো ও ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা।

অর্র্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। অর্থাৎ উৎপাদন, চাহিদা, ঘাটতি, আমদানি কোন পর্যন্ত করতে হবে, কখন দরকার- এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারকরা কোথায় কখন কোন পণ্যের ঘাটতি হবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। বাজারে কখন ঘাটতি হতে পারে, সেই বার্তা আগেভাগেই আমদানিকারকদের দিতে হবে। ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখেনি। ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি কমেনি। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থার (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদহার বাড়ালে টাকা আরও দামি হবে। তখন ডলারের চাহিদা কমে আসবে।

তিনি বলেন, ভারতসহ প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তিনি মনে করেন, ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো ঠিকই আছে। সিদ্ধান্তগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

গত ৬ই জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মূল্যস্ফীতি কমানোর উপায় খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, অর্থনীতিতে এখন দুটি প্রধান উদ্বেগ আছে; একটি বিদ্যুতের সমস্যা, অপরটি মূল্যস্ফীতি।

গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হয়। এই সময়ে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এখন তো ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারি হিসাবেই তা এতটা হলে বাস্তব পরিস্থিতি আরও নাজুক। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি ও সানেম দাবি করেছে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বিদ্যমান হারের চেয়ে দ্বিগুণ।

২০২২ সালের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি চলছিল। দেশটির পরিসংখ্যান বিভাগ জানায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সেই হার প্রায় ১০ গুণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬.৩ শতাংশে। যে সময়ে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ, একই সময়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার গত এক যুগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৯.৯৬ শতাংশে পৌঁছায়। দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা যা পেরেছে, তা রোল মডেলের বাংলাদেশ পারলো না কেন এ প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমবেশি বেড়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে, যার মধ্যে আছে ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কাও। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তির দিকেই।

এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এগুলো সব ধরনের পণ্য আমদানিতেই প্রভাব ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমদানি কমানো। কিন্তু এটি করতে গিয়ে খাদ্যপণ্যের জোগান কমে গেছে। ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম যখন কমা শুরু হয় তখন বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব পড়েনি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমাতে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে সেটি হলো সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়নি। এ ছাড়া এখানে বাজারে কারসাজির প্রবণতা আছে যা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ঠেকাতে পারছে না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। মূল বিষয় হলো- চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিমভাবে ভারসাম্যহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে অনেক নাজুক অবস্থায় থাকলেও শ্রীলঙ্কার বাজার ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী। সে কারণে তারা মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। অন্যান্য যেসব দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, তাদের বাজার ব্যবস্থাপনাও শক্তিশালী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।

বিশ্ব বাজারে কমেছে পণ্যের দাম: বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে-এ সত্যকে আমরা ধারণ করি। কিন্তু এর বিপরীতে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে তার ইতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারে দেখতে পারি না। গত জুন ২০২২-এ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১১২.৭ ডলার। এক বছর পর ২০২৩ সালে জুন মাসে সেই জ্বালানি তেলের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪.৯ ডলারে। এ কমতির হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। পাম অয়েলের দাম তো প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০২২-এর জুনে প্রতি টন পাম অয়েলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল ১ হাজার ৬৩৪ ডলার। ২০২৩ সালের জুনে সেই পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ৮১৭ ডলার। সয়াবিন তেলের দামও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক বছর আগে সয়াবিনের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সেই তেলের দাম এখন টনপ্রতি ১ হাজার ৭ ডলার। দাম কমেছে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের। গমের দামও কমেছে। ২০২২ সালের জুনে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৪৯২ ডলার। ২০২৩ সালের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫ ডলারে।

মূল্যস্ফীতি কী?: সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতি হলো- একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে এখন একই পণ্য বা সেবা কিনতে হচ্ছে। বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে।

আরো পড়ুন : নানা বিতর্কের মধ্যেই পবিত্র ওমরাহ পালন করতে গেলেন রাখি সায়ন্ত

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *