নিজস্ব প্রতিবেদক : বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বিলটির সমালোচনা করে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নতুন আইনটিও মানুষের বাক্ ও চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এটি সংবিধান পরিপন্থী।
বুধবার জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা বিল পাস হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন এই আইন করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোর প্রায় সব একইভাবে রাখা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা বিলে। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়েছে।
বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত হলেও তা অবারিত নয়।
বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, আইনটি নতুন করে হচ্ছে; কিন্তু স্বস্তি ফিরে আসছে না। কারণ, এটি নতুন বোতলে পুরোনো মদ। যেভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল, অনেকটা সেভাবেই এই আইন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের যেসব আপত্তি ও উদ্বেগের বিষয় ছিল, সেগুলো এতে রয়ে গেছে।
মোকাব্বির বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিল সম্পাদক পরিষদ। এখন প্রস্তাবিত আইনে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে; কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি। দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর থেকে দুটি ধারা বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছিল; কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে তা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এই আইন দিয়ে খুব সহজেই কাউকে হয়রানি করা যাবে উল্লেখ করে মোকাব্বির খান বলেন, ‘এই আইন সাংবাদিকদের জন্য কতটুকু হুমকিস্বরূপ তা সহজেই অনুমান করতে পারি। রাষ্ট্রের যখন একজন শীর্ষ ব্যক্তি একটি জনপ্রিয় লিডিং পত্রিকাকে বলতে পারেন-এটি দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। এমন কথা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
অভিযোগ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ওই পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা যেতে পারে। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি কত বড় হস্তক্ষেপ তা সহজেই অনুমান করা যায়। যদিও হুমকির কারণ হিতে বিপরীত হয়েছে।’
মোকাব্বির খান আরও বলেন, এই আইন ভিন্নমত, সমালোচনা ও মুক্তচিন্তা দমনের সবচেয়ে কার্যকর একটি হাতিয়ার। গত সাড়ে চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কেবল সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা ও মুক্তচিন্তা দমনে প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এই আইনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে সাংবাদিক সমাজ। এই আইনের কারণে তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এই আইনে পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিস ও দেহ তল্লাশি, পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আইনটিতে কিছু রদবদল করা হয়েছে; কিন্তু সাংবাদিকেরা বলেন, তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান হলো মূল আইন।
বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো আইন তৈরি হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, সাংবাদিকেরা কলম ধরেন দেশের স্বার্থে। তাঁদের বিষয়ে প্রেস কাউন্সিলকে যুক্ত করার সুযোগ ছিল। ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আছে। এ সময় তিনি সম্প্রতি ছাত্রলীগের দুজন নেতাকে থানায় নিয়ে নির্যাতনের ঘটনার কথা তুলে ধরেন।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, এই আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনে সাংবাদিকদের বিষয়ে আলাদা সুরক্ষা রাখা প্রয়োজন ছিল। প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ছিল। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৭ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাদী ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সংবিধানে চিন্তা, সংবাদক্ষেত্র ও বাক্স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এগুলো সংবিধানে থাকা অবস্থায় এই ধরনের আইন সংবিধানবিরোধী। এই আইনে অপরাধের সংজ্ঞা একই রাখা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়েছে। এই আইনের ফলে গণমাধ্যমের সেলফ সেন্সরশিপ বাড়বে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ৪২ ধারা নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। এটিসহ সব বেআইনি ধারা বাদ দেওয়া দরকার।
প্রতিমন্ত্রীর জবাব
বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত হলেও তা অবারিত নয়। স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করা নয়, যা ইচ্ছা তা বলা নয়, নারীকে অশ্লীল কথা বলা নয়।
জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, সময়ের প্রয়োজনে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। এখন সময়ের প্রয়োজনে আবার সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নিরাপদ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সাইবার নিরপত্তা আইনের বিকল্প নেই।
পরে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন সভাপতির আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক। এরপর বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
আইনে যা আছে
৫ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে তোলা হয়েছিল। এরপর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সেখানে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু ধারায় শব্দগত পরিবর্তন আনা হয়। পাশাপাশি ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ এই বিল থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মিথ্যা মামলা করার অপরাধে সাজার বিধানও যুক্ত করা হয়। তবে এর পরও বেশ কিছু ধারা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আপত্তি আছে।
বিলের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এ ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যম থেকে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ ও ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো বা তাতে মদদ দেওয়া হবে অপরাধ। এর সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
বিলে আরও বলা হয়েছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে প্রকাশ করলে বা করালে তাঁর সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
বিলে বলা হয়েছে, কোনো ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রচার করলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করেন যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
আরো পড়ুন : মাকে বিদায় দিয়ে বাবার দাফনের জন্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় ফিরছেন মেয়েরা