টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ মেট্রোরেল চলাচল। দুর্বৃত্তদের তাণ্ডবে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মেট্রো চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এক বছরেও এই দুই স্টেশন চালু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে বাকি স্টেশনগুলোতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সেখানে কেন মেট্রোরেল চালানো হচ্ছে না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্থ দুই স্টেশন বন্ধ রেখে ট্রেন চালানো যেতে পারে। অবশ্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষও নিয়ে কোনো জবাব দিচ্ছে না। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এক বিবৃতিতে বলেছেন, আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অজুহাতে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঠামোগত ও কমিউনিকেশন সিস্টেমে কোনো ক্ষতি না হলে ক্ষতিগ্রস্ত দুই স্টেশন বন্ধ রেখে মেট্রোরেল চালানো যেতে পারে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনের সংস্কার কাজ চলমান রাখা যেতে পারে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গত ১৮ই জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় ব্যাপক সংঘাত হয়। একপর্যায়ে মিরপুর-১০ পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
ওই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ওভার ব্রিজের উপর। সংঘর্ষ চলমান থাকায় তখন মেট্রোরেলের মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে ওই সময়ে অন্য স্টেশনগুলোতে চলছিল মেট্রোরেল। একইদিন বিকাল ৫টার দিকে ডিএমটিসিএল এক বিজ্ঞপ্তিতে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘অনিবার্য কারণবশত জননিরাপত্তার স্বার্থে মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশন থেকে সর্বশেষ মেট্রো ট্রেন বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে উত্তরা উত্তর মেট্রোরেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।’ তবে ওই বিজ্ঞপ্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে মেট্রোরেলে চলাচল করা যাত্রীদের। আগের মতো লক্কড়-ঝক্কর বাসে চলাচল করতে হচ্ছে তাদের। আগের মতো বাসে যানজটে নাকাল অবস্থার মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের প্রশ্ন তুলেছেন মেট্রোরেল বন্ধ রাখা নিয়ে। তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনে মেট্রোরেলের দুই/একটি স্টেশন ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুই/একটি টোল প্লাজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেট্রোরেলের ইঞ্জিন, বগি ও লাইনের কোনো ক্ষতি হয়নি বলেই জানি। সে কারণে, ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলো বন্ধ রেখে, মেট্রোরেল অবিলম্বে চালু করা সম্ভব বলে মনে করছি। একইভাবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর কোনো ধরনের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়নি। প্রয়োজনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করে যান চলাচল পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অজুহাতে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। এগুলো সাধারণ মানুষের অর্থে সাধারণ মানুষের সেবার জন্যই নির্মাণ হয়েছে। জনগণ এখন মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং কষ্ট পাচ্ছে। মেট্রোরেলের ইঞ্জিন, বগিসমূহ ও লাইনের কোনো ক্ষতি হয়নি বলেই জানি। এই সেবাগুলো চালু রাখাও সরকারেরই দায়িত্ব।
ক্ষতিগ্রস্ত দুই স্টেশন ছাড়া বাকি স্টেশনে মেট্রোরেল চালু করা হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক এর কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারবো না। এখনো আমরা কেনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, কবে মেট্রোরেল চালু হবে সেটা আমরা বলতে পারবো না। জাপানের এক্সপার্ট টিম দেখে গেছে। শুধু দু’টো স্টেশন নয়, আমাদের প্রসেসটা পুরো সিস্টেম নিয়ে চলে। এক্সপার্টরা কাজ করছে। তারা মতামত দিবে। মতামত পেলে আমরা বলতে পারবো। আমরা যত দ্রুত সম্ভব মেট্রোরেল চালানোর চেষ্টা করবো। সময়টা বলতে পারছি না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হাদিউজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত দু’টো স্টেশন ঘিরে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সেখানে টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞরা আছে। তাদের পর্যবেক্ষক দল আসার আগেই যে, বলা হচ্ছে এক বছর লাগবে, ছয় মাস লাগবে; এটা না বলাই যৌক্তিক। তিনি বলেন, মেট্রোরেলে কমিউনিকেশন সিস্টেমে কোনো ক্ষতি না হলে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দু’টো স্টেশনে কাঠামোগত ক্ষতি না হলে ওই দু’টি স্টেশন সাময়িক বন্ধ রেখে মেট্রোরেল চলানো যেতে পারে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনের সংস্কার চলতে পারে। তিনি বলেন, মেট্রোরেল অপারেশনের সময় সবগুলো স্টেশন তো একসঙ্গে খোলা হয়নি। ধাপে ধাপে খোলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত দুই স্টেশনে যেসব বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সংস্কার কাজ চলতে থাকুক। বাকি স্টেশনগুলো চালু করে মেট্রো চালানো যেতে পারে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আগুনে ভায়াডাক্টের কোনো কাঠামোগত সক্ষমতার ক্ষতি হয়েছে কিনা সেটা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হয়। এটা খুব দ্রুত করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে এই পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল। এই ধরনের বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশেও আছে। অর্থাৎ যখনই জানা যাবে, এখানে কাঠামোগত ক্ষতি হয়নি তারপর দিন থেকেই দুই স্টেশনে না থেমে মতিঝিল পর্যন্ত অপারেশন চালানো যায়। তবে ওই স্টেশনের সেবা দিতে গেলে পুরো স্টেশনকে সংস্কার করতে হবে। নতুন উপকরণ বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলোর কাজও দ্রুত ঠিক করা যায়। কমলাপুর পর্যন্ত লাইন বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে এই ধরনের স্টেশনের উপকরণ পাইপলাইনে আছে। এটাকে ওই জায়গায় না লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরো পড়ুন : কয়েকদিনের মধ্যেই খুলে দেয়া হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে