♦ বিদেশি চাপ সামলানো ♦ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ♦ সুশাসন নিশ্চিত করা অর্থ পাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ ♦ মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ♦ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
আওয়ামী লীগ সরকার টানা চার মেয়াদে শপথ নিয়েছে গত বৃহস্পতিবার। নতুন দায়িত্ব নেওয়া এ সরকারের সামনে মোটাদাগে ছয়টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই সরকারকে সামনের দিকে এগোতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা, অর্থনৈতিক চাপ সামলে গতি সচল রাখা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, অর্থ পাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ করা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, সরকারের ইমেজ বাড়ানো এবং সুশাসন নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এর মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সাবেক আমলা, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছি, সেটা বাস্তবায়নই আমাদের মূল টার্গেট। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। আমাদের একটা বিশ্বাস আছে, আজ যে এই সংকট অতিক্রম করে একটা শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছি, এটা জননেত্রী শেখ হাসিনার ম্যাজিক লিডারশিপের জন্য সম্ভব হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জও আমরা অতিক্রম করব।’
সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, সামনের পাঁচ বছর খুব দেখেশুনে পা বাড়াতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। এজন্য শুরু থেকেই পরিকল্পনামাফিক দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালিয়ে নিতে চায় সরকার। দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ছয়টি অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হয়েছে। মানুষকে স্বস্তি দিতে সবার আগে দ্রব্যমূল্য কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বাজেট বাস্তবায়ন ও সম্পদ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একাধিক বৈঠক করে এসব অগ্রাধিকার নিয়ে একটি ধারণাপত্র তৈরির কাজ শুরু করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উন্নয়ন নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। দরকার সত্যিকারের সুশাসন। এজন্য কঠোর আইন প্রয়োগসহ আইন প্রয়োগকারীদের স্বাধীনতাও দেওয়া দরকার। হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ছাড়াও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। যারাই মাদকের সঙ্গে যুক্ত হোক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘সুশাসন নিশ্চিত করা এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো দুটোই কঠিন। এই চ্যালেঞ্জ সরকারি দলকেই নিতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সন্তানদের ছোট থেকেই সচেতন করতে হবে। সমাজে মাদকের চাহিদা কমলে সরবরাহও কমে যাবে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঠিকভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কোনো ধরনের অন্যায় তদবির মানা যাবে না। আবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যেন অন্যায়ভাবে কোনো কিছু না করে, নিরীহ মানুষ যেন হয়রানি না হয় সেজন্য কঠোর মনিটরিং করতে হবে। আর সুশাসন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। অপরাধী যেই হোক তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সুশাসন নিশ্চিত হবে।’
বর্তমান সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এক ধরনের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা অভিনন্দন জানালেও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা এবং বর্তমান সরকারের ইমেজ বাড়ানো। সে কাজটি করতে বর্তমান সরকার সক্ষম হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, জাতির পিতার পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। সেটা ফলো করে বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোনো চাপের কাছে তিনি মাথা নত করেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অনেক সময় অনেক চাপ এসেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোনো চাপের কাছে তাঁর নীতি থেকে সরেননি। সে কারণে বিশ্বের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। আরও অনেকেই আগ্রহ দেখিয়েছেন। বর্তমানে যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও জ্ঞানী মানুষ। আশা করি, তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আরও সুসম্পর্ক গড়তে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে বার্তা দিয়েছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত।’
আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলার জন্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা গত পাঁচ বছরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আ হ ম মুস্তফা কামালকেই দায়ী করেন। তিনি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করায় আর্থিক খাতে নজিরবিহীন স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি বারবার যেটা বলে চলেছি সেটা হলো- যিনি গত পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি আসলে ওই পদের জন্য যোগ্য ছিলেন না। সেটা ছিল একটা রং চয়েস। অর্থনীতি নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তিনি ছিলেন অদক্ষ। নিষ্ক্রিয়ও ছিলেন। নেতৃত্ব দিতে পারেননি। দক্ষতার কোনো পরিচয় তিনি রেখে যেতে পারেননি। তিনি নিজের কাজে মনোযোগীও ছিলেন না। দায়িত্ব পালনের কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি। যার ফলে এসব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অফিসটাও ঠিকঠাক মতো করেননি। ফলে কতগুলো গভীর সংকট তৈরি হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এর পুরো দায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তারই। এখন নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে নতুন যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ মানুষ, যদিও অর্থনীতিতে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আমরা আশা করব, আমাদের সংকটগুলো কেটে যাবে। তিনি এসব সংকট সমাধানে চেষ্টা করবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা এই প্রত্যাশা করি যে, তিনি চেষ্টা করলে তা পারবেন।’
আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য অবশ্য ব্যাংক খাতের দুর্নীতি কমাতে ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর্থিক খাতের বিভিন্ন আইন ও কাঠামোগত সংস্কারেও আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখে রিজার্ভ বৃদ্ধি করাও অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা তো উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এ সম্ভাবনাগুলোকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে আমি অবশ্য সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ বলছি না। এগুলো আসলে করণীয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ ধরে রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো, উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানো-এসব তো আমাদের করতেই হবে। অন্যথায় অর্থনীতি সচলই থাকবে না বলে তিনি মনে করেন। এদিকে বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে ভারসাম্য আনাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি হিসাবের ঘাটতিটা বাড়ানোর কারণে মূলত ডলার সংকট বেশি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এজন্য এই সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। বিভিন্ন সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর লাগাম টেনে ধরতে হবে এ সরকারকে। তা করতে না পারলে কঠিন মাশুল গুনতে হবে। নতুন সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিকসহ সব খাতেই আমাদের সংস্কার আনা জরুরি। বৈশ্বিক খাতগুলোতেও নজরদারি বাড়াতে হবে। হুন্ডি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে হবে যে কোনো মূল্যে। সম্পদের অপচয় ঠেকাতে হবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এখানে শুধু তথাকথিত উদ্যোগ নয়, কার্যকর সমাধান খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
আরো পড়ুন : টর্চার সেলে রাতভর নির্যাতন চালিয়ে যুবককে হত্যা, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বহিষ্কার