সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে গুজব শক্তিশালী, অসহায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ বিনোদন মুক্তমত হ্যালোআড্ডা

আইনি সীমাবদ্ধতাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কনটেন্ট সরানো জটিল হওয়ায় গুজব হয়ে ওঠে শক্তিশালী। আর গুজবের ফলে অনেক সময় সত্য ঘটনা চাপা পড়ে যায়। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও গুজব ঠেকাতে হচ্ছে ব্যর্থ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্ট কোনো দেশেই বন্ধ করার সুযোগ না থাকায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) অনেকটা অসহায়। দেশের বিদ্যমান আইনে গুজবে জড়িত কাউকে শনাক্ত করে বিচারেরও তেমন নজির নেই। এমন বাস্তবতায় গুজবে জড়িত ব্যক্তি বা আইডি নিয়ে অনেকটা অন্ধকারে থেকে কাজ করে সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন চলাকালে সরকার দলীয় লোকজন ও গার্মেন্টস মালিকদের ভাড়াটে মাস্তানদের হাতে তিনজন শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার একাধিক ভিডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ৩১ আক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘নওশাদ লাইফ লাইন’ নামক আইডি থেকে ৬ মিনিটের ওই ভিডিও রেকর্ডে এক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা আন্দোলনে ছিল তাদের দৌড়ে দৌড়ে পিটায়ছে। তিনজন মহিলা মারা গেছে। তাদের মধ্যে একজন তিন মাসের প্রেগনেন্ট (অন্তঃসত্ত্বা) ছিল।’

জনবানী নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকেও একই ধরনের কিছু ভিডিও ছড়ানো হয়। সেখানে এক নারী উচ্চস্বরে বলেন, ‘আমাদের তিন বোনের লাশ দেখতে চাই। নইলে আগুন জ্বলবে।’ একই সময়ে শ্রমিকরা দাবি করেন, জোসনা বেগম নামের এক গার্মেন্টকর্মী মারা গেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে মিরপুরে কোনো শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেনি। উলটো জোসনা বেগম নামে যে শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার গুজব ছড়ানো হয়, তাকেই ১ নভেম্বর রাজধানীর পল্লবীর কালশী এলাকা থেকে জীবিত উদ্ধার করে র‌্যাব। যদিও গাজীপুরে বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুজন পোশাক শ্রমিক মারা যান।

কিন্তু মিরপুরের বিক্ষোভের সময় ছড়ানো গুজব এখনো রয়ে গেছে ফেসবুকে। অতীতেও ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফরমে গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়। গুজবকে কেন্দ্র করে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে করে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে। ছেলে ধরা সন্দেহে ২০১৯ সালে তাসলিমা বেগম রেণু নামে একজন মাকেও রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই হত্যায় জড়িতরা অবশ্য পরে শনাক্ত হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে। কিন্তু এমন অসংখ্য ঘটনা থেকে গেছে পর্দার আড়ালে। কিন্তু ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেও নানা রকম গুজব ডালপালা পাখা মেলছে। এমন ঘটনাও ঘটছে দেশের স্বনামধন্য পত্রিকার ‘লোগো’ কপি করে ফেইক নিউজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলের চলমান কর্মসূচি ঘিরে পুরোনো ছবি ব্যবহার করে শিরোনাম নিজেদের মতো দিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মাঝে মাঝে গুজবের শিকার হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এবং র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থার পৃথক সাইবার মনিটরিং ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে গুজব ঠেকাতে নিয়মিত সাইবার প্যাট্রোলিং করছে। কিন্তু গুজব ঠেকাতে সুফল পাচ্ছে না তারাও। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গুজব অনলাইন থেকে সরানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষ ধীরগতিতে কাজ করে। বিটিআরসি যেসব কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করে তার সবই সরানো হয় না।

মানবাধিকার সংগঠন এমপাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অব দ্য কমন পিপল’র (এলকপ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতাধিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ‘ফেইক নিউজ’ (ভুয়া খবর) দায়ী।’ তারা গত ২৮ অক্টোবর গুজব বা ভুয়া খবর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় অনেকাংশেই ‘ফেইক নিউজ’ (ভুয়া খবর) দায়ী।

প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এমন গুজব ঠেকানো যাবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশনস মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কখনো দেশ থেকে, কখনো দেশের বাইরে থেকে অনেক আগের পুরোনো ছবি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানো হয়। সাইবার ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দেওয়া আছে, এই মিথ্যা সংবাদ যেন সম্প্রচার না হয়। তিনি বলেন, ‘গুজব খুব পুরোনো জিনিস, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গুজব ছড়ানো হয়। এটা একেবারে নির্মূল করা যায় না; তবে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’

তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বলেন, আমাদের দেশে গুজবকে কেন্দ্র করে অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে আইডেন্টিফাই (শনাক্ত) করা হয়েছে। আমাদের এখানে সাইবার অপরাধকে আইনের কাঠগড়ায় পৌঁছে বিচার করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। ফলে এসব গুজব ছড়ানোর ঘটনার কোনোটিরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ গেটওয়ে ফিল্টারেশন সফটওয়্যারের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে উল্লেখ করে এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, সম্ভবত নির্বাচনের আগেই এটা বাস্তবায়ন হবে। তখন ফেইক নিউজ বা গুজব সরকারের নিজস্ব সক্ষমতায় বন্ধ করতে পারবে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন কনটেন্ট সরাতে কাজ করে তারা। গুজবের ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয়। ভুয়া তথ্য বা গুজব সরানোর ক্ষেত্রে বিটিআরসির তরফ থেকে যেসব অনুরোধ করা হয়, তার সব সরানোও হয় না।

নাম প্রকাশ না করে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন উপপরিচালক বলেন, ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কনটেন্ট কোনো দেশেই বন্ধ করার সুযোগ নেই। এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবসায়িক গোপনীয়তা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের যেসব লিংক দেয় সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করি। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করি।

আরো পড়ুন : ঘটনার তিনদিন পর সৌদি থেকে ফিরে স্ত্রী-দুই মেয়েকে চির বিদায় জানালেন মঞ্জিল

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *