ব্যুরো প্রধান, সিলেট : সিলেট বিভাগ স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কবলিত হয়েছে। প্রায় এক’শ বছরের ইতিহাসে এমন বড় ধরনের বন্যা আগে হয়নি এমন কথা জানালেন অনেক প্রবীণ মুরব্বী। একমাসের মধ্যে দু’দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়ে মানুুষ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে বন্যার পানি কমতে ধীরগতি হওয়ায় একটু বৃষ্টি হলেই আবার নতুন করে প্লাবিত হয়। এতে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বন্যা জনিত কারণে এ পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ৭৮ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র পানিতে ডুবে মারা গেছেন ৫৭। বাকীরা বজ্রপাত, টিলাধ্বস, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ নানা কারণে মারা যান। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে এ পর্যন্ত ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া মানুষের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে যায়,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালপত্র পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়,গবাদি পশু ,হাস,মুরগি ও আসবাবপত্র পানিতে ভেসে যায়।
অনুসন্ধানে পাওয়া ৭৮ জন মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ জন হলেন সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। এছাড়া সিলেট জেলায় ২৭ূ জন, মৌলভীবাজার জেলায় ৬ জন ও হবিগঞ্জ জেলায় ৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায়ই ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সিলেট জেলার সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ ১৩ টি উপজেলা ও ৫ টি পৌরসভা বন্যার পানিতে প-াবিত হয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েন। এ পর্যন্ত জেলার ৬১৪ টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫২,৭৮৪ জন লোক আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রত্যক্ষভাবে গ্রামীণ জনপদের ৪,৮৪,৩৮৩ টি পরিবার বিভিন্নভাবে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে এবং ফসল নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন।বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির তালিকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। সিলেট জেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সিলেটের কানাইঘাটের ১ নং লক্ষী প্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের মমতাজগঞ্জ বাজারের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বাজার থেকে পাশ্ববর্তী গ্রাম নক্তি পাড়ায় তার নিজ বাড়িতে ফেরার পথে বানের পানির প্রবল ¯্রােতে নৌকা ডুবে নিখোজ হন। ৪-৫ দিন পর পাশ্ববর্তী এলাকা সুরমা নদীর চরে তার লাশ ভেসে ওঠলে স্বজনরা উদ্ধার করেন।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের ফল ব্যবসায়ী এরালিয়ার বাসিন্দা আনহার মিয়া (৩০) বন্যার পানির তীব্র স্রোতে ১৮ জুন নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ হন। দু’দিন পরে তার লাশ পাওয়া যায় শান্তিগঞ্জ উপজেলার বড়মোহা গ্রামের হানিফা বেগম (১০) ছাতকের জাউয়া বাজারে নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিল। বাড়িতে বন্যার পানি উঠে গেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছিলেন তারা। নৌকাযোগে জাউয়া ডিগ্রি কলেজে যাওয়ার পথে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে তীব্র স্রোতে নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকায় থাকা সকলেই পানিতে পড়ে যান। কোনো মতে অন্যরা রক্ষা পেলেও স্কুল ছাত্রী হানিফার খোঁজ মিলেনি । দু’দিন পরে ঘটনাস্থলের কিছু অদূরে কাইতকোনা গ্রামের হাওরে হানিফার লাশ ভেসে উঠে।
দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ভাটিধল গ্রামের গিয়াস উদ্দিন (৬২) ও তার পুত্র সেনাউর মিয়া (২০) ১৮ জুন সকালে পার্শ্ববর্তী ভরাউট গ্রামে যেতে নৌকায় করে রওয়ানা হন। কিছুদূর যেতে না যেতেই প্রচন্ড বজ্রপাতে পিতাপুত্র নৌকা থেকে হাওরে পড়ে নিখোঁজ হন। দু’দিন পর পুত্র সেনাউরের লাশ ভেসে উঠলেও পিতা গিয়াস উদ্দিনের সলিল সমাধি হয়েছে বলে স্বজনরা ধারণা করছেন।
ছাতকে উপজেলার নাদামপুরের হাজী মো. মখলিছুর রহমান (৫০) ১৮ জুন গ্রামের পশ্চিমের রাস্তা পার হতে গিয়ে তীব্র স্রোতে হারিয়ে যান। ঘটনার ৫ দিন পরে পশ্চিম বিতরকুলাই হাওরে তার লাশ পাওয়া যায়। চলমান বন্যায় এ সকল লোকজন পানিতে ডুবে মারা গেলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৃত্যু তালিকায় তাদের নাম নেই।
বন্যায় সিলেট বিভাগে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বন্যা জনিত কারণে ৫৩ জনের কথা নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে, বাস্তব চিত্রের সাথে এর মিল নেই।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের পাগনার হাওরে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবিতে বিপ্টু মজুমদার (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। এর আগে সোমবার জগন্নাথপুর পৌর এলাকার হরিহরপুরে পানিতে ডুবে শিশু আরিয়ানের (৭) মৃত্য হয়। মৃত্যুর আগের দিনও সে পরিবারের জন্য ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসে। একই উপজেলার ইছগাঁও গ্রামের সানু মিয়া (৬৫) জগন্নাথপুর-শিবগঞ্জ সড়ক দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে স্রোতের পানিতে নিখোঁজ হন। তার সলিল সমাধি হয়েছে বলে স্থানীয়রা ধারণা করছেন।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাইশঘর গ্রামের মতছিন আলীর স্ত্রী লিমা বেগম (৩৫) ও শ্যালিকা সীমা বেগম (২৫) বানের পানিতে ডুবে মারা যান । ওইদিন বিকেলেই আপন দুই বোন লিমা ও সীমার লাশ এলাকায় ভেসে উঠে। এলাকার সকল কবরস্থান পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সিলেট নগরের একটি কবরস্থানে তাদেরকে দাফন করা হয়।
সিলেট সদর উপজেলার নলকট গ্রামে তীব্র স্রোতে গ্রামের আব্দুল হামিদ (১৮) তলিয়ে যান। পরে তার লাশ পাওয়া যায়। বিশ্বনাথে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন শামিম আহমদ (৬০)। ২০ জুন তার লাশ মিরেরগাঁও এলাকায় ভেসে উঠে। একইদিন খাজাঞ্চির চন্দ্রগ্রামের নিখোঁজ অনিক দাস ওরফে মোহন দাসের (২০) লাশ পাওয়া যায়। উপজেলার সিওরাওলী গ্রামের আলতাবুর রহমান (৪৫) পানিতে ডুবে মারা যান। ১৯ জুন পানিতে ডুবে মারা যান কানাইঘাট উপজেলার নারাইনপুর গ্রামের ফয়সল আহমদ। সিলেট নগরীর বাদামবাগিচার (১নং গলি) মোবারক হোসেন (১৫) গত ২৪ জুন শহরতলির বাইশটিলায় পানিতে ডুবে মারা যায়। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার রন রিকমনের (৩৫) লাশ ভেসে উঠে নিখোঁজের ৩৫ ঘন্টা পরে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামের সাজু মিয়া (৭০) সিলেট থেকে ১৭ জুন সুনামগঞ্জে ফেরার পথে সিলেট- সুনামগঞ্জ সড়কের মদনপুর এলাকায় পানিতে নিমজ্জিত সড়ক পার হতে গিয়ে স্রোতের তোড়ে ভেসে যান। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান (৪৮) মাইজবাড়ী থেকে নবীনগর আসার পথে ১৬ জুন বানের পানিতে ভেসে যান। ৩ দিন পর তার লাশ ভেসে উঠে। ছাতক উপজেলায় ছৈলা- আফজলাবাদ ইউনিয়নের রাধানগরের খালেদ (২৭), মুক্তিরগাঁও এর তমাল মিয়া (২২), ছাতক বাজারের পিযুষ (৫০), ফকিরটিলার হাফিজ আলী (৩২) ও চৌকা গ্রামের আরও একজন বানের পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এছাড়াও জগন্নাথপুর পৌর এলাকার ইকড়ছই বৈইঠারটেক নামক স্থানে ১৯ জুন রোববার সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো একটি লাশ ভেসে যেতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আহমদ হোসেন এ প্রতিবেদকের নিকট বলেন, বন্যার সময়তো নেটওয়ার্ক ছিলনা, যোগাযোগ ছিলনা। এজন্যে অনেক তথ্য হয়তো ঠিকভাবে আসেনি। তথ্য ভেরিফাই করে আমরা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করব। ছাতকে মানুষ মারা গেছেন, কিন্তু তালিকায় তাদের নাম আসেনি। এজন্যে তালিকাটা সংশোধন করে নেয়া হবে। যাতে করে মৃত্যুবরণকারী সকলের নাম তালিকায় স্থান পায়।
সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত এ বিষয়ে বলেন, ঘটনার পর হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসেছেন। এরপর মৃত্যু হয় বা মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এমন তথ্যই আমরা পেয়েছি। মূলত আমাদের নিজস্ব কর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে। এর বাইরের তথ্য হয়তো আসেনি। এ জন্যে তথ্যগত গরমিল থাকতে পারে।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে সকল বিভাগের সমন্বয়ে তথ্য হালনাগাদ করা হতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন এ সম্পর্কে বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। এদের কেউ মাছ ধরতে গিয়ে, কেউবা বজ্রপাতে মারা গেছেন। নৌকা ডুবিতেও মৃত্যুর ঘটনা আছে। এর বাইরে আর কোনো মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে নেই।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য সম্পর্কে তিনি জানান, ওই তালিকা যারা করেছেন, এর ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, বন্যায় সিলেট জেলায় ১০ জনের মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে এসেছে। এর মধ্যে বন্যার পানিতে কেউ ভেসে গিয়ে মারা গেছেন, কেউ বজ্রপাতে মারা যান। পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে। তবে, আমাদের নিকট এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের মো. আসকন্দর আলী, সিলেট সদর উপজেলার রজব আলী ও জৈন্তাপুরের আলমগীর হোসেন (৩৫) নৌকা ডুবে মারা যান। জৈন্তাপুরের জুবের আহমদ (৩৫), সাফি (৫), সুমি বেগম (২৫), শামিমা বেগম (৬০) ও গোলাপগঞ্জের অপুরুদ্র পাল (২৭) অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ধসে মারা যান। কানাইঘাটের হাবিবুর রহমান (৫১), আব্দুল্লাহ (৩২) নৌকা ডুবে মারা গেছেন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের তাওহিদা বেগম (১৩), রিপা বেগম (১৩), আমিরুল ইসলাম (১১) ও শুক্কুর আলী (২১) বজ্রপাতে নিহত হন। সিলেট সদরের টিটু চৌধুরী (৩৫) বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। বিশ্বনাথ উপজেলার অজিত রায় (৩৫), সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের জরিফ আহমদ (১৫) পানিতে ডুবে মারা যান। মৌলভীবাজারের বড়লেখার অর্জুন ব্যানার্জী (৬৫) অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসে ও কুলাউড়ার সিপু মিয়ার (৩৫) সর্প দংশনে মৃত্যু হয়। বড়লেখার সুমাইয়া আক্তার (৯), গোলাপগঞ্জের সিদ্দিক (৯), জৈন্তাপুরের মজিবুন বেগম (৫০) ও আব্দুর রহমান (২১) পানিতে ডুবে মারা যান। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সাদ্দাম হোসেন (৩৫) বজ্রপাতে মারা যান। একই উপজেলার মো. আবুল কাশেম (৩৮), মো. ইমাম উদ্দিন (৬৫) ও সালমান হাসান (৪) পানিতে ডুবে মারা যান। ওই উপজেলার হনুফা বেগম (৫০) টিলাধসে, শফিক মিয়া (৩২) বজ্রপাতে মারা গেছেন। একই উপজেলার আনফর আলী (৪৪), জাহানারা বেগম (৬০), খুশী রানী দাস (৬০), আব্দুল হাসিম (৫৫), তামান্না আক্তার (১৬), সৌরভ মিয়া (১০) পানিতে ডুবে মারা গেছেন। শান্তিগঞ্জ উপজেলার গয়াস মিয়া, লুবনা খাতুন (১৮), সুইটি আক্তার (৯), ঝনটু দাস (৫০), সফিকুল ইসলাম (৬২), মীম (১২), মজম্মিল (৫৩) পানিতে ডুবে মারা যান। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিম আক্তার ১৮ মাস পানিতে ডুবে ও শতবর্ষী মনমোহন বিশ্বাস পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় মারা যান। জৈন্তাপুরের বিলাল আহমদ (৪৫), আজমিরীগঞ্জের তারা মিয়া (৫০) ও নবীগঞ্জের সুমাইয়া (৪) পানিতে ডুবে মারা যান। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ইমরান আহমদ ১৭ মাস সর্প দংশনে, আজমিরীগঞ্জের দেড়বছরের মেরাজুল পানিতে ডুবে, সিলেট সদরের সাহেদা বেগম (২১) বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও একই উপজেলার ইমরান আহমদ (৩০), লাখাই উপজেলার মো. রিয়াদ মিয়া (৪) এবং কমলগঞ্জের তামিম আহমদ (৭) পানিতে ডুবে মারা যায়।
কাওছার আহমদ, সিলেট ব্যুরো
আরো পড়ুন : দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের পক্ষে আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল