সিলেট সিটি নির্বাচনে এবার কি হবে বিএনপির ‘দূর্গে’ 

অনুসন্ধানী জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

সিলেট ব্যুরো: সুরমা নদীর বাঁেক উত্তর তীর ঘেঁেষ গড়ে ওঠেছে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ১০, ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ড। ভোটের রাজনীতিতে এ ওয়ার্ডগুলো সবসময় আলোচনায় থাকে। অতীতের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনগুলোর ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নগরীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই ওয়ার্ডগুলোতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা সবসময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। এছাড়া সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় সাংগঠনিক ভিত্তিও অনেকটা মজবুত রয়েছে। ভোটের সমীকরণ সহ নানা কারণে এ ওয়ার্ডগুলো নগরবাসীর কাছে বিএনপির ‘দূর্গ’ হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয়রা জানান, দুই দশকের বেশি সময় ধরে ১০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন জেলা বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ। গত নির্বাচনে অবশ্য এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের পদটি উদ্ধার করেন সাবেক ছাত্রলীগনেতা মো. তারেক উদ্দিন। এদিকে, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক আহবায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী দীর্ঘদিন ছিলেন ১১ নং ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি। এখন অবশ্য মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য রকিবুল ইসলাম ঝলক হলেন এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সিসিকের ১২ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. সিকন্দর আলী। তিনি সিসিকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন। সিকন্দর আলী নগর বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবারের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কিছুদিন আগে বিএনপি ছেড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদেননি।

এ তিন ওয়ার্ডে মোট ভোটার হলেন, ৪৪ হাজার ২’শ ৬৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২২ হাজার ৩’শ ৭৫, নারী ভোটার ২১ হাজার ৮’শ ৯০ এবং হিজড়া ১ জন।
১০ নং ওয়ার্ড

বেত ও কুটির শিল্পের জন্য এ ওয়ার্ডের পরিচিতি দেশে-বিদেশে রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। বেতের তৈরী নানা কারুকার্যের ফার্নিচার সহ পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এখানে আসেন। বেত ও কুটির শিল্প সমৃদ্ধ এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর হলেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি মো. তারেক উদ্দিন। এবারও নির্বাচন করছেন। এর আগে এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ। তিনি দুই দশকের বেশি সময় এ ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার আগে পৌরসভা থাকাকালীন সময়েও তিনি এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (তখন কমিশনার বলা হতো) ছিলেন।

এবারের নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিলর মো. তারেক উদ্দিন ছাড়াও প্রতিদ্ব›দ্বীতা করছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া মাসুক, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ ছাইদুর রহমান, সমাজসেবক মো. আব্দুল হাকিম, মো. মোস্তফা কামাল, আফতাব উদ্দিন।

নগরীর কলাপাড়া, নবাব রোড (আংশিক), ডহর, মোল্লাপাড়া, ঘাসিটুলা, মজুমদারপাড়া, লামাপাড়া, কানিশাইল ও শামীমাবাদ এলাকা নিয়ে ১০ নং ওয়ার্ড গঠিত। এ ওয়ার্ডের মোট ভোটার হলেন ১৮ হাজর ৫’শ ৪৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ হাজার ২’শ ২৮ জন এবং নারী ভোটার ৯ হাজার ৩’শ ১৭ জন।

স্থানীয় কলাপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রব জানান, আমাদের এলাকার ৮০ শতাংশের বেশি লোক বিএনপিকে সমর্থন করে। বর্তমান সরকারের আমল ছাড়া প্রত্যেকটি স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করতো। এজন্য এই ওয়ার্ডকে বিএনপির দূর্গ বলা হয়ে থাকে।

লামাপাড়ার বাসিন্দা রহমান মিয়া বলেন, এ এলাকায় আওয়ামী লীগের কোন সংগঠক না থাকায় দল শক্তিশালী হচ্ছেনা। যারা আছেন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘাসিটুলা ও কানিশাইলের দুইজন বাসিন্দা জানান, এলাকার কয়েকটি স্থানে প্রভাবশালী মহলের শেল্টারে অনৈতিক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। যিনি অপরাধমুক্ত এলাকা করতে পারবেন ভোটাররা তাকে সমর্থন করবেন।

কাউন্সিলর পদপ্রার্থী গোলাম কিবরিয়া মাসুক বলেন, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়ে থাকে। এছাড়া রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। পরিকল্পিত উন্নয়ন না হওয়ায় জনদুভোর্গ কমছেনা।

বর্তমান কাউন্সিলর মো. তারেক উদ্দিন বলেন, গত ৫ বছরে এই ওয়ার্ডে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জনগণ আবারও সমর্থন করবেন।

 

১১ নং ওয়ার্ড
সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক আহবায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী দীর্ঘদিন এই ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি ছিলেন । তিনি গত এক দশক ধরে নির্বাচন করছেননা। বর্তমানে কাউন্সিলর হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী সদস্য রকিবুল ইসলাম ঝলক। বর্তমান এই কাউন্সিলর ছাড়াও ভোটে রয়েছেন মহানগর কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব বাবলু, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল রহিম, ব্যবসায়ী মীর্জা এসএম হোসেন।

নগরীর লালদীঘিরপার, কুয়ারপার, সচিলাপুর, বিলের পার, নয়াপাড়া, লামাবাজার, মধুশহীদ, ভাতালিয়া, রিকাবী বাজার (আংশিক), দক্ষিণ কাজলশাহ এলাকা নিয়ে ১১ নং ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডে মোট ভোটার রয়েছেন ১৪ হাজর ৭’শ ৮৭ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৭ হাজার ৫’শ ১৫ জন এবং নারী ভোটার ৭ হাজার ২’শ ৭২ জন।

কুয়ারপার এলাকার জাকির হোসেন বলেন, স্থানীয় ও জাতীয় প্রত্যেকটি নির্বাচনে আমাদের এলাকায় বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সিলেট সদর আসনের এমপি মরহুম খন্দকার আব্দুল মালিক ও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের সময় থেকে এখানে বিএনপি পাশ করে আসছে। এখনও এখানকার বিএনপির লোকজন সুসংগঠিত ও সক্রিয় রয়েছে।

বিলের পারের বাসিন্দা রাসেল হোসেন বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রভাব তেমন পড়েনা। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন করেন।
ভাতালিয়ার বাসিন্দা শফিকুর রহমান জানান, জলাবদ্ধতা ও খাবার পানির সমস্যা রয়েছে। এছাড়া মশার উপদ্রবে এলাকাবাসী অতিষ্ট। এসবের সমাধান চান এলাকাবাসী।
কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আব্দুর রকিব বাবলু বলেন, পরিকল্পনার অভাবে প্রত্যাশিত উন্নয়ন হচ্ছেনা। এছাড়া জলাবদ্ধতা ও সুপেয় খাবার পানির সমাধান জরুরী।

বর্তমানে কাউন্সিলর রকিবুল ইসলাম ঝলক বলেন, গত ৫ বছরে রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ, ড্রেনেজ সংস্কার সহ দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে। জনগণ কাজের মূল্যায়ন করলে আমাকে আবার সমর্থন দিবে।

 

১২ নং ওয়ার্ড
হযরত শাহজালাল (র.) সুরমা নদী পার হয়ে যে এলাকা দিয়ে সিলেট নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন এ এলাকা শেখঘাট। এই বৃহত্তর শেখঘাটের পাশ^বর্তী সওদাগরটুলা, ভাঙ্গা টিকরপাড়া, কুয়ারপার দক্ষিণ, ইটাখলা ও শেখঘাট কলোনি নিয়ে এ ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডের ভোটার রয়েছেন ১০ হাজর ৯’শ ৩৪ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ হাজার ৬’শ ৩২ জন, নারী ভোটার ৫ হাজার ৩’শ ১ জন এবং হিজরা ১ জন।

সিসিকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হলেন মো. সিকন্দর আলী। তিনি এক সময় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তবে এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এ ব্যাপারে সিকন্দর আলীর সাথে কথা হলে তিনি সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, এলাকাবাসির উন্নয়নের জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন। জনগণের উন্নয়নের জন্যই তিনি রাজনীতি করেন।

এবার এই প্রভাবশালী কাউন্সিলরের সাথে ভোটযুদ্ধে রয়েছেন ট্রাভেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির। একমাত্র তিনিই প্রতিদ্ব›দ্বীতা করছেন। ট্রাভেল এজেন্সিদের সংগঠন আটাবের সিলেট বিভাগের সেক্রেটারীর দায়িত্বে আছেন মোহাম্মদ আব্দুল কাদির । তিনি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন। তবে বর্তমান কাউন্সিলর মো. সিকন্দর আলীর দাবি মোহাম্মদ আব্দুল কাদির স্থানীয় জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছেন। এদিকে কেন্দ্রের নির্দেশে বিএনপির কোন নেতাকর্মী এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। এতে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা নীরব রয়েছেন। তবে নির্বাচনে বড় ধরনের ফ্যাক্টর হতে পারে বিএনপি ঘরানার এই ভোটগুলো।

কাউন্সিলর পদ প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির জানান, নগরীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে তেমন উন্নয়ন হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিত উন্নয়নের অভাবে জনদূর্ভোগ কমছেনা। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পানির সংকট ও মশার উপদ্রব তো আছেই।

সওদাগর টুলার বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন বলেন, উন্নয়নের সাথে এলাকার পরিবেশও সুন্দর করার মনমানসিকতা থাকে এমন জনপ্রতিনিধি চাই।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শেখঘাট এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, কয়েকটি স্পটে জুয়া খেলা সহ অনৈতিক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। প্রভাবশালীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলেনা। এসবের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো প্রতিনিধি খুঁজছে সাধারণ ভোটাররা।

সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৪
সিসিকের ১০, ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ড নিয়ে নারী কাউন্সিলরদের সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৪ গঠিত। এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর হলেন মাসুদা সুলতানা। এবারও নির্বাচন করছেন। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয় নন। গত ৫ বছরে এলাকায় উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তাঁর দাবি হলো পুরুষ কাউন্সিলরদের সাথে সমন্বয় করে এলাকায় দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন করেছেন।
এবারের নির্বাচনে ভোটের মাঠে বর্তমান এই কাউন্সিলরের সাথে আলোচনায় রয়েছেন আরও ৮ নারী প্রার্থী। এরা হলেন উম্মে সালমা, অ্যাডভোকেট জোহরা জেসমিন, তাহমিনা বেগম, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মোছা. রুহেনা খানম মুক্তা, রুপিয়া খাতুন, রুবি বেগম, সালমা বেগম, সুনিয়া আক্তার সূচনা।

কাওছার আহমদ

আরো পড়ুন : বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মুসলিমদের সামাজিক মাধ্যম ‘আলফাফা’

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *