সেবা পেতে ডেঙ্গু রোগীদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে স্বজনদের। সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি না থাকায় মেঝেতে রেখে অনেক রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়েও স্বজনদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রোগী বাড়ায় বেড়েছে স্যালাইনের চাহিদাও। এতে কোথাও কোথাও স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে ৬৪ জেলায়। এতে সবার মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিটেও রয়েছে সংকট। বেশির ভাগ হাসপাতালেই ডেঙ্গু শনাক্তের কিট সংকটের কারণে রোগী ও স্বজনরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এতে সুযোগ নিচ্ছেন বেসরকারি ক্লিনিক মালিকরা। এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এদিকে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপ সামাল দিতে রোগীদের মেঝেতেও রাখতে হচ্ছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিভিন্ন জটিল রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। নেই কোনো মশারির ব্যবস্থা। রোগীর এত চাপের পরও করা হয়নি আলাদা ইউনিট বা ওয়ার্ড। এসব হাসপাতালে একাধিক রোগী ও স্বজন জানান, কম খরচে ভালো চিকিৎসা নিতে এসে বিড়ম্বনায় পড়ছেন বেশির ভাগ মানুষ। হাসপাতালটিতে টিকিট কাটা, রক্ত জমা দেয়া, টেস্টের ডেলিভারি রিপোর্ট পাওয়া, ডাক্তার দেখানো এবং ওষুধ সংগ্রহ করতে লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়ানোসহ প্রতি পদে পদে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আর দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রোগীরা। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাইরে থেকে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তাতে খরচও বেশি হচ্ছে।
হাসপাতালে জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ বলছেন, রোগী বাড়লেও চিকিৎসক বাড়ছে না। তাই চাহিদার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় চাপ সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনে দু’টি ডেঙ্গু ইউনিট রয়েছে। একটি ভবনের সপ্তম অপরটি ষষ্ঠ তলায়। এই দুটি ইউনিটই ঘুরে দেখা গেছে, নির্ধারিত শয্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি। রোগীর এত চাপের পরও করা হয়নি আলাদা ইউনিট বা ওয়ার্ড। অন্য রোগীর সঙ্গে চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। ঢামেকের প্যাথলজি বিভাগ ও রিপোর্ট সংগ্রহ করার রুমে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত মানুষ লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে আসছেন ডেঙ্গুর পরীক্ষা করার জন্য। আবার অনেকেই রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের চাপ সামাল দিতে হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। আবার রিপোর্ট পাওয়ার জন্য একই রকম ভোগান্তি ও সময় নষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের টিকিট কাউন্টার, ডেঙ্গু পরীক্ষায় বুথ, ওষুধ কাউন্টার, প্যাথলজি বিভাগ, রিপোর্ট সংগ্রহ করার রুমে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। একাধিক দীর্ঘ লাইনে রোগী ও স্বজনরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন।
স্যালাইনের ঘাটতি: ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে স্যালাইনের চাহিদা। এই চাহিদাকে পুঁজি করে একদিকে বেড়েছে দাম, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে সংকট। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিনামূল্যে স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। বেসরকারি হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয় শিরায় প্রয়োগের ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ নরমাল স্যালাইন) স্যালাইন। সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিডেট (ইডিসিএল) বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি এক্মি, পপুলার, ওরিয়ন, বেক্সিমকো, স্কয়ার, লিব্রা ও অপসোনিন-এর কাছ থেকে স্যালাইন কিনে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে থাকে। সংকট দেখা দেয়ায় গোপালগঞ্জে নিজস্ব কারখানায় স্যালাইন উৎপাদন করা হবে বলে জানিয়েছেন ইডিসিএলের কর্মকর্তারা। ডিএনএস স্যালাইনের দাম মাত্র ১০০ টাকা হলেও বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে, ডায়রিয়া বা কলেরা হলে অথবা কখনো কখনো রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় দেয়া স্যালাইন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। তিনি বলেন, একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার স্যালাইন দিতে হয়, কোনো কোনো রোগীর এর বেশি প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সংকট: রাজধানী ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে কয়েকদিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। ফলে জ্বর হলেই অনেকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে ভিড় করছেন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয়। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কিট সংকট দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য যেতে হচ্ছে রোগীদের। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জুলাইয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ার পর থেকেই এনএস ১ কিটের চাহিদা বেড়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী কিট মিলছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, ডেঙ্গু কিটের কোনো সংকট নেই। চাহিদা অনুযায়ী সব হাসপাতালে কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে কিট সংকটের বিষয়টি অস্বীকার করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, অধিদপ্তরে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের সংকট নেই। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্যালাইন সংকট ও বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সরকারি কোম্পানি ইডিসিএল আমাদের স্যালাইন সরবরাহ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ইডিসিএল তা সম্পূর্ণভাবে করতে পারছে না। আমরা এ বিষয়ে সব হাসপাতালকে নির্দেশনা এবং টাকা বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছি। হাসপাতালগুলো এখন লোকাল মার্কেট থেকে স্যালাইন কেনার ব্যবস্থা নেবে। বাজার কন্ট্রোল করার দায়িত্ব তো আর আমাদের না। আর আমরা এটা পারবোও না। ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের দাম বেড়েছেÑএ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বেশি দাম দিয়ে কারা কোথা থেকে কিনছে এটা আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। আমরা সব জায়গায় ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছি। আমাদের প্রতিটি হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণে কিট দেয়া হয়েছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে কিট মজুত আছে। তবে লোকজনকে তো আমাদের কাছে আসতে হবে।
ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ১৪ প্রাণহানি, এক সপ্তাহে ৭৬ জনের মৃত্যু
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দিন দিন পরিস্থিতি খুবই অবনতি হচ্ছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত শনাক্ত প্রায় ৭০ হাজার রোগী। একদিনে আরও ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৭ জনে। গত এক সপ্তাহে মারা গেছেন ৭৬ জন। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুতে পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৭৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত ৩২৭ জনের মধ্যে নারী ১৮৪ জন এবং পুরুষ ১৪৩ জন মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৬৯ জন এবং রাজধানীতে ২৫৮ জন। গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৭৫১ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ১১৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৩২ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৭৫১ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৭২ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ হাজার ৬৫২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪ হাজার ৯২০ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৪৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ৪৪ হাজার ১৫৮ জন এবং নারী ২৫ হাজার ৩২৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫৯ হাজার ৫৮৪ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগস্টের ৭ দিনে ১৭ হাজার ৬৫১ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ৭৬ জনের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।
আরো পড়ুন : নতুন কোনো নিবর্তনমূলক কোন আইন দেখতে চাননা ৩১ সংগঠন