বিশেষ প্রতিবেদক: দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনি লড়াইয়ে নেমেছেন আওয়ামী লীগেরই নেতৃবৃন্দ। এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেশির ভাগই নির্বাচনি প্রতীক পেয়েছেন ট্রাক, ঈগল, ফুলকপি আর কাস্তে। তবে বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীক ট্রাক আর ঈগল। নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন এসব প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন নৌকার মাঝিরাও। সব মিলিয়ে ভোটের মাঠে নৌকার বিরুদ্ধে জমজমাট লড়াই চলছে ট্রাক, ঈগল, ফুলকপি আর কাস্তেওয়ালাদের। এসব প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্র্থীদের সরব প্রচারণায় তীব্র চাপের মুখে আছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং এমপিসহ দলের শতাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে হারের শঙ্কা আছে অনেকেরই। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রার্থীকে সমর্থন করা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন। কোথাও আবার চলছে মারামারি। নানা চাপ ও গৃহদাহের এ নির্বাচন ঘিরে চায়ের দোকান, হাট-বাজার, রাস্তাঘাটে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে হচ্ছে আলোচনা।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রার্থীই নিজেদের প্রতীক হিসেবে ঈগল বেছে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাননি কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন এমন আলোচিত হেভিওয়েট প্রার্থীরাই ঈগল প্রতীকের দিকে ঝুঁকছেন বলেও আলোচনা রয়েছে। ঈগল প্রতীক পেয়েছেন এমন প্রার্থীরা অবশ্য বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য যেসব প্রতীক রাখা হয়েছে তার মধ্যে এটি মানসম্মত হওয়ার কারণেই সেটি পছন্দ করেছেন তারা।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট প্রার্থী রয়েছেন ১৮৯৫ জন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ৩৮২ জন। তাদের মধ্যে ১৫২ জন প্রার্থীই ঈগল প্রতীক বেছে নিয়েছেন। সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের প্রার্থীদের প্রতীক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মোট ১৭ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন, যার মধ্যে ঈগল প্রতীক পেয়েছেন সাতজন।
ঢাকা-৫ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হারুনুর রশিদ মুন্নার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল (ট্রাক) ও কামরুল ইসলাম রিপন (ঈগল)। ঢাকা-১৯ আসনে নৌকার প্রার্থী দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক মার্কা নিয়ে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং (মুরাদ জং)। ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম (নৌকা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সহকারী সচিব ড. আওলাদ হোসেনের (ট্রাক) মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।
এদিকে গাজীপুরের ৫টি আসনে নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ট্রাক মার্কা নিয়ে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ট্রাক মার্কা নিয়ে গাজীপুর-১ আসনে রেজাউল করিম রাসেল লড়ছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে। গাজীপুর-২ আসনে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন মাঠ কাঁপাচ্ছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বিরুদ্ধে। গাজীপুর-৩ আসনে ইকবাল হোসেন সবুজ লড়ছেন রুমানা আলী টুসীর বিরুদ্ধে। গাজীপুর-৫ আসনে ডাকসুর সাবেক ভিপি মো. আখতারুজ্জামান লড়াই জমিয়ে তুলেছেন মেহের আফরোজ চুমকির বিরুদ্ধে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জমজমাট লড়াইয়ে নির্বাচনি হাওয়া বইছে বরিশাল-২ আসনে। নৌকার মাঝি ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে নবম সংসদের আওয়ামী লীগের এমপি মনিরুল ইসলাম মনিরের। তার ঢেঁকি মার্কার প্রচারণা চলছে। তিনি এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী।
বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে লড়ছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান। তার প্রতীক ট্রাক।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য (এমপি) ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে সাবেক এমপি চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাহেনুল হক রায়হান লড়ছেন। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঁচি প্রতীক নিয়ে মাঠে তিনি।
লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনে নৌকার মাঝি বর্তমান এমপি মোতাহের হোসেন। তার বিরুদ্ধে জমজমাট লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঈগল মার্কার আতাউর রহমান প্রধান। আতাউর রহমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটির সদস্য।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালিগঞ্জ) নৌকার বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই চলছে ঈগল মার্কার। নৌকার মাঝি সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল হক।
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনে নৌকার মাঝিকে চোখ রাঙাচ্ছে ঈগল মার্কা। আওয়ামী লীগ প্রার্থী সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদার বিরুদ্ধে ঈগল মার্কা নিয়ে লড়ছেন মেজর জে. (অব.) আবুল হোসেন। আবুল হোসেন রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব এবং বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন।
বাগেরহাট-৩ (রামপাল ও মোংলা) নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে ঈগল মার্কার। এ আসনে নৌকার মাঝি চারবারের সংসদ সদস্য ও বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের প্রার্থী পবিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার।
জেলার অন্য তিনটি আসনের ভোট নিয়ে ভোটারসহ সাধারণের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও বাগেরহাট-৩ আসনে সাবেক মোংলা উপজেলার চেয়ারম্যান ও বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইদ্রিস আলী ইজারাদার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল মার্কা নিয়ে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে আছেন।
কুড়িগ্রাম-৩ আসনে নৌকা, লাঙল আর ট্রাকের ত্রিমুখী লড়াইয়ে জমে উঠেছে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডের নৌকার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন জাপার প্রার্থী আব্দুস সোবহান। অন্যদিকে, সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. আক্কাস আলী সরকার ট্রাক মার্কা নিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনে জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর প্রার্থী রুহুল আমীন। তার প্রতীক বাইসাইকেল। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা অ্যাডভোকেট বিপ্লব হাসান পলাশ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন। তার নৌকা প্রতীক ও বাইসাইকেল প্রতীকে হবে এক ধরনের লড়াই।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একই আসনে লড়াই জমিয়ে তুলেছেন তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এরা হলেন- ঈগল মার্কার মজিবর রহমান বঙ্গবাসী, ট্রাক মার্কার শহিদুল ইসলাম শালু এবং কাঁচি মার্কার অ্যাডভোকেট মাছুম ইকবাল।
জয়পুরহাট-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে নৌকা বনাম কাঁচির। নৌকার মাঝি হিসেবে মাঠে আছেন সামছুল আলম দুদু। তার বিপরীতে কাঁচি মার্কায় লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বহিষ্কৃত সাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জয়পুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল আজিজ মোল্লা।
ঝিনাইদহ-১ আসনে মূল লড়াই চলছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল হাই এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম দুলালের। দুলালের নির্বাচনি প্রতীক ট্রাক।
ঝিনাইদহ-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল। মহুলের প্রতীক ঈগল।
ঝিনাইদহ-৩ আসনে নির্বাচনি লড়াই জমে উঠেছে নৌকা, ট্রাক এবং ঈগলের মধ্যে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) সালাউদ্দিন মিয়াজী, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল (ট্রাক) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার নবী নেওয়াজ (ঈগল)- এই তিনজন ত্রিমুখী লড়াইয়ে নেমেছেন।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক যুবলীগ নেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। সুমনের প্রতীক ঈগল।
কুমিল্লা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কুমিল্লা-৬ সদর আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী সংরক্ষিত নারী এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি মো. মুজিবুল হকের সঙ্গে স্বতন্ত্র মো. মিজানুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-খুলশী) আসনে নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র মনজুর আলম পেয়েছেন ফুলকপি প্রতীক। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ পেয়েছেন কেটলি প্রতীক। এই আসনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৯জন হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে নৌকা, ফুলকপি আর কেটলির মধ্যে।
আরো পড়ুন : জমজমাট নির্বাচনি প্রচারনা, স্বতন্ত্র ঠেকাতে মরিয়া নৌকার প্রার্থীরা