লেখা: আফরোজা সোমা
নারীকে ‘মুক্ত’ করার কিছু নেই। সব মানবশিশুর মতো সেও শিকল ছাড়াই জন্মায়। ক্রমে একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েটির স্বাধীনতা হরণ করতে থাকে। আমাদের দেশেও স্বাধীনতা হরণের গল্পেরই অপর নাম নারীতে পরিণত হওয়ার গল্প।
কিন্তু পৃথিবীব্যাপী অধিকার হরণের এই বাস্তবতা অনেকেই পাল্টে দিতে চেয়েছেন। তাঁরা অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন। তাঁরা বৈষম্য বিলোপের কথা বলেছেন। তাঁদেরই একজন আমাদের রোকেয়া। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
রোকেয়া দিবসে আজ খতিয়ে দেখা যেতে পারে, পুরাণের নারী থেকে এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনোত্তর বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতা কতখানি অর্জিত হলো। খতিয়ে দেখা যেতে পারে রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা।
মহিলা একজন ভদ্রমহিলা
আন্তর্জাতিক একটি বেসরকারি সংস্থার বাংলাদেশের বর্তমানে কান্ট্রি ডিরেক্টর একজন নারীর কথা বলছি। ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকায় তাঁর বাস। কর্মসূত্রে তাঁর স্বামী তখন ইউরোপে। ঘটনাচক্রে সেই সময়েই তাঁর বাসাবদল আবশ্যক হয়ে ওঠে।
যে হাউজিংয়ে তিনি থাকতেন, সেখানকারই অন্য আরেকটা ফ্ল্যাট খালি থাকায় তিনি সেখানে উঠতে চাইলেন। কিন্তু ‘একা মহিলা’, ‘স্বামী বিদেশ’, ‘বাচ্চা কাচ্চাও নাই’-তাঁকে কি বাসা দেওয়া যায়? শুরু হলো নানান টালবাহানা।
গণতন্ত্রহীন একটা অন্যায্য সমাজে ‘সংখ্যায় লঘু’ মানুষদের যে বিড়ম্বনা, নারীরও তা–ই। নারী এখানে সংখ্যায় নয়, ক্ষমতায় লঘু। তার এই লঘুত্ব একাধারে সমাজের নির্মাণ এবং জীবনে অসহায়ত্বের কারণ।
‘মহিলা’র আয় যতই হোক, সংসারের খরচ যে-ই চালাক, তিনি তো পুরুষ নন! অতএব তিনি ‘অর্ধেক মানুষ’। সেই ‘একা থাকে একটা মহিলা’ অথবা ‘অর্ধেক মানুষ’টির হয়ে ফ্ল্যাটের মালিককে সুপারিশ করেন হাউজিংয়ের ম্যানেজার। তিনি বুঝিয়ে বলেন, ‘মহিলা একজন ভদ্রমহিলা। ওনাকে বাসা ভাড়া দেওয়া নিরাপদ।’
তারপরও মালিক নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। ‘কেস’ তিনি ‘হ্যান্ডওভার’ করে দেন মালিক সমিতির কাছে। সমিতির সভাপতি ও তাঁর স্ত্রী দুই দফা ‘কথা বলেন’ তথা ‘ইন্টারভিউ’ নেন সেই ‘একা নারীর’।
এত কিছুর পরও বাসা তিনি পাবেন কি না নিশ্চিন্ত নন। ঘটনার শেষ দিকে সিনেমার মতন হাজির হন তাঁর পরিচিত এক ছোট ভাই। সেই ছোট ভাইয়ের শ্বশুর নিজে ফ্ল্যাটমালিক হওয়ায় মালিক সমিতির লোকজনকে চিনতেন। অবশেষে তিনি ‘এনডোর্স’ করেন বা ‘সার্টিফেকট’ দেন এই বলে যে ভালো পরিবারের ভালো মেয়ে। বড় চাকরি করেন। বাসা দিয়ে দেন।
এই হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাস করা উচ্চ বেতনে চাকরি করা একজন নারীর গল্প। আর আমার গল্প বা অন্য আরেক সোমা ও শিউলির গল্প আজকে নাহয় ঊহ্য থাকুক। কেননা, এই গল্পে আমাদের নামগুলো মুছে দিলে যে ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ বা একটা বড় গল্প পাওয়া যায়, তা–ই আজ আমাদের অভীষ্ট।
যে তুমি হরণ করো
সুইডেনের ফোজো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সহায়তায় এমআরডিআইয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদন ২০২৩ সালে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ ১০ শতাংশের কম। যদিও টিভি খুললেই দর্শকের এই বলে ভ্রম হতে পারে যে মিডিয়ায় তো নারীরই জয়জয়কার!
গণমাধ্যম তথা দেশের সব প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আপনি যদি নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণের অনুপাত দেখতে যান, মনে হবে আপনি খড়ের গাদায় সুই খুঁজছেন। কারণ, বাংলাদেশে পলিসি মেকিংয়ে নারীর অংশগ্রহণ নিতান্তই নগণ্য। সেটা রাজনীতি থেকে সমাজনীতি-সবখানেই।
বাংলাদেশে নারী-পুরুষের জমির মালিকানার অনুপাত জানেন? অক্সফামের এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ২০১৯ সালে ডেইলি স্টার জানিয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি জমির মালিকানা পুরুষের হাতে।
২০২২ সালে করা বিবিএসের জরিপের ফল বলছে, বাংলাদেশে ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারে প্রধান সিদ্ধান্তপ্রণেতা পুরুষ। আর মাত্র ১২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের প্রধান সিদ্ধান্তপ্রণেতা নারী।
অথচ সংখ্যায় কিন্তু নারী ও পুরুষের অনুপাতে এত ফারাক নয়। ২০২২ সালের বিবিএসের জরিপের বরাত দিয়ে ঢাকা ট্রিবিউন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে নর ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৮ কোটি ৭৩ লাখ এবং ৮ কোটি ৪২ লাখ।
প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেয়েরা ভালো ফল করে এবং ছেলে-মেয়ের অনুপাতের পার্থক্য খুব সামান্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকে, চাকরিতে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুপাত কেন ক্রমেই কমতে থাকে? রোকেয়া দিবসই এ প্রশ্ন করার একটা ভালো দিন বটে!
নারীর সংখ্যালঘু–দশা
যে কথা বলে এই লেখা শুরু করেছিলাম, নারীকে ‘মুক্ত’ করার কিছু নেই। শুধু তাকে ছল-বলে-কৌশলে বন্দী না করলেই হবে।
এখানেই আসে সমাজ-মানসের প্রশ্ন। এখানেই আসে সমাজের প্রতিবন্ধকতার প্রশ্ন।
নারীর এই অধস্তনতা নির্মিত। তার নিম্নবর্গীয়তা আমাদের পিতৃতান্ত্রিক একপেশে সংস্কৃতির আচার-আচরণ, রীতিনীতি, আইনকানুনের নির্মাণ।
নারীর এই বাস্তবতাকে আমি সাধারণত এক বাক্যে এভাবে প্রকাশ করি, নারী হচ্ছে গরিবের মধ্যেও গরিব এবং ছোটোলোকের মধ্যেও ছোটলোক।
গণমাধ্যম ও নারীর অধিকার বিষয়ে আমার নিজের প্রকাশিত একটি গ্রন্থ আছে। সেটিতে আমি নারীর এই বাস্তবতাকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোয় আনতে চেয়েছি। তত্ত্বটির নাম দিয়েছি ‘সংখ্যালঘু-দশা’ তত্ত্ব।
গণতন্ত্রহীন একটা অন্যায্য সমাজে ‘সংখ্যায় লঘু’ মানুষদের যে বিড়ম্বনা, নারীরও তা–ই। নারী এখানে সংখ্যায় নয়, ক্ষমতায় লঘু। তার এই লঘুত্ব একাধারে সমাজের নির্মাণ এবং জীবনে অসহায়ত্বের কারণ।
ঠিক এ কারণেই একজন নারীর ‘একা নারী’ হওয়া মানে মানুষের খাতা থেকে তাঁর নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাটা পড়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন অর্ধেক মানুষ।
বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘আমাদের শয়নকক্ষ যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করেনা, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলো প্রবেশ করিতে পারে না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল-কলেজ এক প্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারেন—কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরুপ সুধাভাণ্ডারের দ্বার কখনো সম্পূর্ণরুপে উন্মুক্ত হইবে কী?’
রোকেয়া বর্ণিত ‘সূর্যালোক’ এখন নারী ও পুরুষ—উভয়ের মনঃকক্ষে প্রবেশ করা প্রয়োজন। কেননা, একপেশে, অন্যায্য সমাজ পাল্টাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ জরুরি।
২০২৪ সালে আমরা দেখেছি দেয়ালে অঙ্কিত রোকেয়ার কালিমাখা মুখ। আর এই কালিমাখা মুখই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে রোকেয়া আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক।
একজন নারীর ‘ভদ্রমহিলাত্ব’ প্রমাণের প্রচেষ্টাই সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই সমাজে ‘অবরোধবাসিনী’র জন্য বিদ্যার ভান্ডার উন্মুক্ত হলেও সমাজের হৃদয়ের দ্বার আজও বন্ধ।
ফলে সেই বন্ধ দ্বার খোলার লড়াইয়ে রোকেয়া আজও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘কোনও শকটের (গাড়ির) দুটি চাকা যদি সমান না হয়, তাহলে সেই গাড়ি চলতে পারে না। অসমান চাকা নিয়ে গাড়িটি চালাতে গেলেই সেটি একই চক্রে শুধু ঘুরপাঁক খেতে থাকবে।’
পুরাণের নারী সাবিত্রীকে বড় করার ক্ষেত্রে সাবিত্রীর পিতা রাজা অশ্বপতি ছিলেন ন্যায্য মানুষ। সাবিত্রীকে তিনি জ্ঞানে-গুণে-অস্ত্রবিদ্যায় এমনই সাবলম্বী করে গড়ে তুলেছিলেন যে তাঁর যোগ্যতার ভয়ে কোনো রাজপুরুষ তাঁর হাত প্রার্থনা করতে ‘সাহস’ বা ‘ইচ্ছা’ প্রকাশ করেননি।
কেননা, ‘নতচক্ষু’, ‘নতশির’ নারী দেখে অভ্যস্ত ভারতীয় সমাজে সাবিত্রীকে গ্রহণের মানসই ছিল না। সাবিত্রী তাই নিজেই খুঁজে বের করেছিলেন ‘সত্যবান’কে।
নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস! সাবিত্রীর সাহসের গল্প এই সমাজ ভুলে গেছে। কিন্তু মনে রেখেছে তাঁর ‘পতিব্রতা’ হওয়ার স্মৃতি। এটিকেই বলেই সিলেকটিভ এমনেশিয়া। সমাজ বেছে বেছে শেখায় কোনটা মনে রাখতে হবে আর কোনটা ভুল যেতে হবে।
রোকেয়া দিবসে আজ তাই মনে করাতে চাই, আমাদের এই সমাজে আজ অশ্বপতির মতো অনেক পিতা প্রয়োজন, যাঁরা ঘরে ঘরে সাবিত্রীর জন্ম দেবেন।
আমাদের ঘরে ঘরে আজ রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের মতন অনেক স্বামী প্রয়োজন, যাঁরা রোকেয়ার মতন বুকে প্রদীপ নিয়ে বন্দী থাকা নারীকে বলবেন, ‘পড়ো, লেখো।’
আমাদের ঘরে ঘরে অনেক প্রতিবাদী মানুষ প্রয়োজন, দেয়ালে আঁকা রোকেয়ার মুখে কালি মেখে দিলে যাঁরা চেঁচিয়ে দেশ মাথায় তুলবেন।
আমার কাছে ‘জাগতে রাহো’ কথার প্রায়োগিত অর্থ হচ্ছে বলতে থাকো। রোকেয়াও তা-ই করেছেন। কেননা, বলাতেই মুক্তি।
আফরোজা সোমা কবি, প্রাবন্ধিক এবং মিডিয়া ও জেন্ডার গবেষক।
সুত্র-প্রথম আলো
আরো পড়ুন : গোমস্তাপুরের যত খবর