মশালের চর, ব্রহ্মপুত্র নদের বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের এই চরে বসবাস করতেন সাজেদা বেগম। মাস চারেক আগে প্রসবকালীন জটিলতায় তাঁর মৃত্যু হয়। সাজেদার গর্ভের সন্তানও বাঁচেনি।
সাজেদার মা নাসিমা বেগম জানান, গত ২০ জুন সকালে তাঁর মেয়ের প্রসবব্যথা ওঠে। তখন তিনি অন্যের বাড়িতে কাজে ছিলেন। মেয়ের খবর পেয়ে দ্রুত বাড়িতে ফেরেন। খবর দেন স্থানীয় দাই বিমলা বেগমকে। কিন্তু দিনভর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান বিমলা। এর পর পল্লিচিকিৎসক এসে ইনজেকশন দিলে সাজেদার প্রসবব্যথা তীব্র হয়, তবে সন্তানের জন্ম হয়নি। সন্ধ্যার পর ওই পল্লিচিকিৎসক বলেন, ‘সাজেদাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’ রাত ৮টার দিকে তাঁকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নৌকায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যান সাজেদা। আক্ষেপ করে নাসিমা বলেন, ‘হামার কপাল খারাপ। চরোত বড় ডাক্তার নাই, ওষুধও নাই। কিছু হইলে যাওয়া নাগে (যেতে হয়) কুড়িগ্রাম। নাওত চড়ি (নৌকায়) যাইতে যাইতে মানুষ বাঁচে না।’ এই চরের বাসিন্দারা জানান, সেখান থেকে জেলা সদর হাসপাতাল প্রায় ২৭ কিলোমিটির দূরে। নৌকা ও অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা।
২২ বছরের সাজেদার মৃত্যুর ঘটনাটি কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত চরগুলোতে বেহাল স্বাস্থ্যসেবার চিত্র তুলে ধরে। কুড়িগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জেলায় চার শতাধিক চরের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে মাত্র ৫০টিতে, ক্লিনিক সংখ্যা ২৯৫টি। কিন্তু সব ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সদর উপজেলার ঝুনকার চরের বাসিন্দা আশরাফুল আলমের দুই মেয়ে। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখন তাঁকে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুধু আয়রন ও ভিটামিন ট্যাবলেট দেওয়া হয়। প্রসবব্যথা উঠলে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে নেওয়ার পর দুই মেয়ের জন্ম হয়।
চরের বাসিন্দারা জানান, সপ্তাহে এক-দু’দিন কমিউনিটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের চিকিৎসক ক্লিনিকে আসেন। প্যারাসিটামল ও খাওয়ার স্যালাইন ছাড়া সেখানে অন্য ওষুধ তেমন পাওয়া যায় না। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় অবশ্য বলছে, কমিউনিটি ক্লিনিকে ২৭ ধরনের ওষুধ থাকার কথা। সরঞ্জাম হিসেবে রয়েছে একটি করে চেয়ার, টেবিল, আলমারি, বিপি মেশিন, ওজন মাপার মেশিন ও গ্লুকোমিটার। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা।
তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। জেলার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি তো আছেই, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) সপ্তাহে দু’দিনের বেশি পান না স্থানীয়রা। এমনও হয়, ক্লিনিকের চাবি থাকে আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে, অনেক সময় ওষুধ বিতরণের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাদের। ঝুনকার চরে কমিউনিটি ক্লিনিকের পাশেই কুলসুম বেগমের বাড়ি। গত জুলাইয়ে দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের সময় তাঁকে কমিউনিটি ক্লিনিকে নেওয়ার কথা ভাবেন স্বজন। কিন্তু খোলা থাকার কথা থাকলেও সেদিন বন্ধ ছিল ক্লিনিকটি। দুপুরে কুলসুমের চাচা শ্বশুর আব্দুল মালেক ক্লিনিকের সিএইচসিপি মিজানুর রহমানকে ফোন করলে তিনি জানান, শহরে ট্রেনিংয়ে আছেন। এর পর স্থানীয় দাইয়ের মাধ্যমে প্রসব করানোর পর কুলসুমের দ্বিতীয় সন্তান মারা যায়।
গত আগস্টের মাঝামাঝি পরপর তিন দিন (সোম, মঙ্গল ও বুধবার) ঝুনকার চরের এই ক্লিনিকে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। পরে মোবাইল ফোনে সিএইচসিপি মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অফিসে নিয়মিত উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। তবে এলাকার যোগাযোগ খুব খারাপ, নৌকা ছাড়া যেতে পারি না।’ আশপাশের লোকজন জানান, তারা পালা করে ক্লিনিকটি খোলা রাখছেন, ওষুধ বিতরণের দায়িত্বও পালন করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন নামে একজন এই ক্লিনিকে হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তিনি ক্লিনিকে আসেন না। ফলে স্থানীয়রা তাঁকে চেনেন না। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা মোছা. শাহিনা আক্তার বলেন, ‘হামরা অ্যাটে (এখানে) কয়েক হাজার মানুষ থাকি। কিন্তু একটা ক্লিনিকও নাই। শহর যায়া ডাক্তার দেখাই। অসুখ-বিসুখে দোকান থাকি ওষুধ আনি খাই।’
চিলমারীর অষ্টমীর চর ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মোকারম আলী বলেন, ‘ডাক্তার দেখানো চরের মানুষের জন্য অনেক কষ্টের। বড় সমস্যা হলো, রোগীকে নদী পার হয়ে শহরে নিয়ে যাওয়া। আর যেসব চরে ক্লিনিক আছে, সেগুলোতেও সময়মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না।’ কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা গেছে, গুটিকয়েক কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে নিয়মিত সেবা মিলছে। তবে সেখানেও রয়েছে নানা সংকট। রাজীবপুরের ঢুষমারা থানার কটিয়ার চর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সেটি চালাচ্ছেন একজন পুরুষ সিএইচসিপি। ব্রহ্মপুত্র নদের বিচ্ছিন্ন এই চরে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র বলতে এই ক্লিনিকটি। এখানে পুরুষরা স্বাস্থ্যসেবা নিলেও সমস্যায় পড়েছেন নারীরা। পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নারীরা তাদের ঋতুকালীন সমস্যাসহ অনেক সমস্যার কথা লজ্জায় বলতে পারেন না।
এই ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা ধরনের সেবা নেন। এখানে বিনামূল্যে ২৭ প্রকার ওষুধ সরবরাহ করতেও দেখা যায়। ক্লিনিকটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএইচসিপি মো. মাসুদ ইকবাল বলেন, ‘ক্লিনিকে সব ধরনের ওষুধ রয়েছে। লোকজন প্রতিদিন চিকিৎসাসেবাও নিচ্ছেন। তবে মহিলারা একটু সংকোচবোধ করেন।’ একজন নারী স্বাস্থ্যকর্মী থাকলে ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি। চরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে স্থানীয় সংগঠন ‘সারথি’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জাহানুর রহমান খোকন বলেন, ‘চরে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ক্যাম্প করা প্রয়োজন। আরও ক্লিনিক হলে চরের মানুষের অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে।’
চর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘ভালো যোগাযোগ, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসক-নার্সের অভাবে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের দুই লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। বিদ্যমান কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, আরও ক্লিনিক স্থাপন এবং স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘মূল ভূখণ্ডের মানুষের তুলনায় চরের মানুষ অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকে। হঠাৎ করে বন্যা-ঝড় তাদের ওপর আঘাত হানে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করেই তাদের চরে বসবাস করতে হয়।’ তাঁর মতে, চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় বাজেটে আরও বরাদ্দ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুর এ মুর্শেদ বলেন, ‘চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আরও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের চেষ্টা চলছে। বর্তমান ক্লিনিকগুলোতে যেসব সমস্যা রয়েছে, তাও দূর করা হচ্ছে।’ চরের কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যকর্মী না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অফিসে যাওয়া একজন সিএইচসিপির মৌলিক দায়িত্ব। যারা দায়িত্বে অবহেলা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
আরো পড়ুন : বাচ্চার ‘সিরাপ’ খেয়ে ২ বছর নিষিদ্ধ হলেন বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন তারকা