স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের মামলাতো ঝুলছেই, মেলেনি স্বীকৃতিও

ওকে নিউজ স্পেশাল জনপ্রতিনিধি জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি প্রচ্ছদ প্রবাস মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্মের প্রতিবাদ করে বহু মানুষ বাড়িছাড়া, দেশছাড়া হয়েছেন। যাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনরাও সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে পারেননি। মামলা-হামলায় দুর্বিষহ জীবন কেটেছে প্রতিবাদী মানুষ এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের। ফ্যাসিস্ট সরকারের হুমকিধমকি, মামলার আসামি হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাহসী কিছু সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট। বিদেশে গিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করেও তাঁরা অকুতোভয়ে লড়ে গেছেন নিজ দেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের মুুক্তির জন্য। তাঁরা প্রতিনিয়ত বিগত সরকারের দুঃশাসনের নানা চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছেন। বিশ্বব্যাপী নানা ফোরামে তুলে ধরেছেন নিপীড়িত বাংলাদেশিদের কথা। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানে তাঁদের ছিল অবিস্মরণীয় অবদান। ছাত্র-জনতার অন্তর্বর্তী সরকারের আজ ৮৪ দিন। এখন পর্যন্ত তাঁদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা বা তাঁদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় এখনো তাঁরা দেশের মাটিতে পা রাখতে পারছেন না। মেলেনি কোনো স্বীকৃতিও।

জানা গেছে, যেসব সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট বিদেশে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী, পিনাকী ভট্টাচার্য, তাসনীম খলিল, ড. কনক সারোয়ার, জুলকারনাইন সায়ের খান সামি, ইলিয়াস হোসেন, মনির হায়দার, ফাহাম আবদুস সালাম, শাহেদ আলম, আবদুর রব ভুট্টো, সাইফুর সাগর, নাজমুস সাকিব, জাওয়াদ নির্ঝর, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবসহ আরও অনেকে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এসব প্রতিবাদী ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নামে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে দেওয়া হবে বীরের স্বীকৃতি। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিবাদী সাংবাদিকের মধ্যে মুশফিকুল ফজল আনসারীকে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তবে মামলার কারণে অন্যদের দেশে ফেরার পথটাই এখনো উন্মুক্ত হয়নি।

জানা গেছে, প্রবাসী সমালোচকদের স্বজনদের হেনস্তার অভিযোগ গত ১৫ বছরে বারবার সামনে এসেছে। এর জেরে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করতে অ্যাকটিভিস্ট ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। পেশায় চিকিৎসক, ফ্রান্সে থাকা মানবাধিকারকর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য। তীক্ষè ও ক্ষুরধার বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে একের পর এক ভিডিও বক্তব্য হাজির করেছেন জনগণের সামনে। সরকারের নানা অপকর্মের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আর এ কারণে তাঁর বৃদ্ধ মা এবং মামাকে দেশে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে। চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন তাঁরা। জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান সরকারকেও তিনি নানাভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন।

সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার ইউটিউব টকশোয় স্বৈরাচার সরকারের মুখোশ উন্মোচন করে গেছেন। এজন্য তাঁর পরিবারের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। সরকারের দুর্নীতি আর অনিয়মের ঘটনা বারবারই সামনে নিয়ে এসেছেন। জানা গেছে, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে ২০১৫ সালে নয় মাস জেল খাটার পর ২০১৬ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর তাঁর বোন নুসরাত শাহরিনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হয়। দুই মামলায় নুসরাতকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর প্রায় ছয় মাস কারাগারে থাকার পর ২০২২ সালের ৩০ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশের বাইরে চলে যান নুসরাত। খ্যাতিমান সাংবাদিক তাসনীম খলিল। সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক। গত কয়েক বছরে একের পর এক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করে সরকারের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন। কুখ্যাত আয়নাঘরের বিষয়টি নেত্র নিউজই প্রথম সামনে নিয়ে আসে। গুম, ক্রসফায়ার নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে তোলপাড় তৈরি করে সারা দুনিয়ায়। সুইডেনপ্রবাসী এ সাংবাদিকের মাকে ভয়ভীতি দেখানো হয় বারবার।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাংবাদিক মনির হায়দার। যুক্তরাষ্ট্রে বসেও তিনি অনলাইনে দেশের পক্ষে করেছেন অনেক সেমিনার। ছিলেন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগেও তাঁর বাসা এবং গাড়িতে হামলা চালানো হয়।

সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়। অনুসন্ধানী এ সাংবাদিক শুরু থেকেই সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। দুর্নীতি আর অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করেছেন সাহসিকতার সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রকাশ করেছেন ভয়ংকর সব তথ্য। প্রকাশ করেছেন বহু গোপন নথি, যা সরকারকে বিপাকে ফেলে। দেশে থাকতে তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। দেশ ছাড়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আরও ১২টি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় তাঁকে ছয় মাসের সাজাও দেওয়া হয়। আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রথম আলোচনায় আসেন জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। শেখ হাসিনার সমর্থনে জেনারেল আজিজ আহমেদ পরিবার কীভাবে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তা আলোয় আসে ওই রিপোর্টে। এরপর একের পর এক নানা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের।

সাংবাদিক শাহেদ আলম যুক্তরাষ্ট্র থেকে নানা বিশ্লেষণাত্মক ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝরও পুরোটা সময় সরব ছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একাধিক দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। ইউটিউব চ্যানেল নাগরিক টিভির নাজমুস সাকিবও সরব ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সাংবাদিক আবদুর রব ভুট্টো ভিডিওসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের অপকর্ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। এ কারণে তাঁর পরিবারকেও হয়রানির মুখে পড়তে হয়। বিজ্ঞানী ফাহাম আবদুস সালামের ভিডিও বেশ সাড়া ফেলে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁর বক্তব্য বিপুল আবেদন তৈরি করে। ব্লগার আসাদ নূরের বরগুনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে দুই দিন আটক রাখাসহ অনেক ঘটনা সামনে এসেছে।

আরো পড়ুন : বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *