নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করা প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণীতে প্রায় সবারই সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। অনেকের তথ্যে ব্যাপক গরমিল লক্ষ্য করা যায়। আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা আগের বছরের সঙ্গে এবারের সম্পদ বিবরণী বিশ্লেষণ করে পাঠিয়েছেন।
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে অর্থ ও সম্পদের যেন শেষ নেই বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের
শত টাকা থেকে কোটিপতি রমেশ: ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁও-১ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের প্রার্থী রমেশ চন্দ্র সেনের ২০১৪ সালে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫৯ টাকা। ২০২৩ সালে তার নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার টাকা। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে জানা যায়, রমেশ চন্দ্র সেনের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৫৩ লাখ ৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৮ নির্বাচনের সময় বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে তাঁর ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। এবার দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের হলফনামায় রমেশ চন্দ্র সেনের স্ত্রী অঞ্জলি রানী সেনের কোনো আয় ছিল না। হাতে নগদ টাকাও ছিল না। তবে এবার হাতে নগদ টাকা এসেছে ২৫ লাখ ১০ হাজার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ২০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। তার নামের ব্যবসা থেকে আয় ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ও ব্যাংক থেকে মুনাফা ৫৪ হাজার টাকা।
সাবেক মন্ত্রী ইমাজের সম্পদ বেড়েছে ১৪ গুণ: নওগাঁ : নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনের এমপি সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের আয় ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ। ১৯৭৩, ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালে এই আসনের নির্বাচিত এমপি ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও পুনরায় এমপি হন। ২০১৪ সালে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৬ গুণ। এবার তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৪৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। ২০০৮ সালের হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় দেখান ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে ইমাজ উদ্দিনের অস্থাবর সম্পদের মূল্য ছিল ১৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এবার তাঁর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। ব্যাংকে নগদ জমা রয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ২২ হাজার টাকা। গত ১৫ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ।
আয় ও সম্পদ বেড়েছে মহিবের, স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ: পটুয়াখালী : পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের এমপি মো. মহিবুর রহমানের আয় ও সম্পদ বেড়েছে। সম্পদে পিছিয়ে নেই তাঁর স্ত্রীও। ২০১৮ সালে প্রথমবার এমপি হওয়ার আগে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ২৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এখন তাঁর বার্ষিক আয় ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাঁর আয় বেড়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে এমপিপত্নীর বার্ষিক আয় ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। অথচ আগে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এমপির স্ত্রীর আয় বেড়েছে ৪৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, এমপি মহিবের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ৮০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা থাকলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকার স্থায়ী আমানতসহ মৎস্য খামারে ৪০ লাখ টাকার বিনিয়োগ মিলিয়ে এমপি মহিবের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৬০ লাখ ১১ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এমপি মহিবের স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৫৮ লাখ ১১ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বেশি।
জাপার শংকর পালের পাজেরোর দাম ২ লাখ ৮০ হাজার!: হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শংকর পাল তাঁর এক পাজারো জিপের মূল্য দেখিয়েছেন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ১৫ ভরি সোনার মূল্য উল্লেখ করেছেন ৩০ হাজার টাকা। রিটার্নিং অফিসারের কাছে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর বার্ষিক আয় ৪৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকান ভাড়া ২৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ব্যবসা থেকে ২৯ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ব্যাংক আমানত ৮ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকার। স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকার। তবে ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৬ হাজার টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে শংকর পালের। এই আসনের নৌকার প্রার্থী হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল। তাঁর বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কৃষিখাত থেকে ৩০ হাজার, আইন পেশা থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। নগদ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে যৌথ মালিকানায় ঢাকা, হবিগঞ্জ ও নিজ এলাকায় কিছু জমি আছে। যেগুলোর মূল্য দেখিয়েছেন ২৯ লাখ টাকা।
সম্পদ ও ঋণ বেড়েছে আবদুল ওদুদের : চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগে প্রার্থী মো. আবদুল ওদুদ এমপির ব্যাংকে দেনা রয়েছে ১২ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, তখন ব্যাংকে তার দেনা ছিল ৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বর্তমানে তার নগদ অর্থ রয়েছে ৪০ লাখ টাকা এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতে জমা রয়েছে ১০ লাখ টাকা। মোটরযান রয়েছে ৪০ লাখ টাকার। নিজের বিবাহকালীন স্বর্ণ রয়েছে ৫ ভরি এবং স্ত্রীর স্বর্ণ রয়েছে ৮০ ভরি ও দুই মেয়ের রয়েছে ১২০ ভরি স্বর্ণ। নিজের নামে পৈতৃক ও ক্রয়সূত্রে ১১৫ বিঘা জমি রয়েছে এবং স্ত্রীর নামে রয়েছে ৬ বিঘা জমি। নিজের রয়েছে ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফিলিং স্টেশন এবং ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা মূল্যের দুটি অ্যাপার্টমেন্ট। ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, তার নগদ অর্থ ছিল ৪০ লাখ টাকা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ১০ লাখ টাকা।
শফিকুলের আয় বেড়েছে ১২ থেকে ৩০ গুণ: ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি মো. শফিকুল আজম খান ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা টাকার পরিমাণ প্রায় ১২ থেকে ৩০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০১৮ সালে এই প্রার্থীর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা, যা এবার দাঁড়িয়েছে ৯৬ লাখ ২২ হাজার টাকায়। আলোচ্য সময়ে তাঁর স্ত্রীর ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ৪০ লাখ ৭ হাজার। একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দুটি হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মো. শফিকুল আজম খানের কৃষি খাত থেকে ৫ হাজার টাকা আয় বেড়ে ১ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে তাঁর কোনো শেয়ার, সঞ্চয়পত্র না থাকলেও এবার ৪১ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে প্রার্থীর ২৪ লাখ ৬০ হাজার নগদ টাকা বেড়ে ২৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা হয়েছে। এদিকে একই সময়ে প্রার্থী ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা টাকার পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে প্রার্থীর ৮৮ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং তাঁর স্ত্রীর বেড়েছে ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
আরো পড়ুন : ‘সীমিত’ আসনে সন্তুষ্ট নয় শরিকরা, অপেক্ষায় জাতীয় পার্টি