হাসিনার বিরুদ্ধে এক মাসে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ

আইন-আদালত আন্তর্জাতিক জনপ্রতিনিধি জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি নারী নির্বাচন প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগে মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ২৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাদের হাজির করার নির্দেশ দেন।
সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল ৯টায় সাবেক ১০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ১৩ জনকে কারাগারে থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে তাদের ট্রাইব্যুনালের গারদখানা থেকে এজলাসে তোলা হয়। এ সময় কাচে ঘেরা কাঠগড়ায় বসতে দেওয়া হয় তাদের। ১২টি চেয়ারে বসেন ১২ জন। সবার পরনে ছিল সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। ডা. দীপু মনি বসেন কাঠগড়ার বাইরে একটি চেয়ারে। তাঁর পরনে ছিল কালো পাড়ের সাদা শাড়ি। শুনানির সময় সবাই ছিলেন নিশ্চুপ।

এদিন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, মুহাম্মদ ফারুক খান, শাজাহান খান, ডা. দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে। তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গণহত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ সময় আইনজীবী ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।

তবে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারত চলে যাওয়ায় এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে একটি মামলায় রিমান্ডে থাকায় গতকাল তাদের হাজির করা যায়নি। আগামী ১৭ ডিসেম্বর সবাইকে আবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে বলা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনাক গ্রেপ্তারের আদেশ কার্যকর করতেও বলেন ট্রাইব্যুনাল।

কোনো আসামির পক্ষেই শুনানি হয়নি
এদিন পাঁচ আসামির পক্ষে ট্রাইব্যুনালে শুনানি করতে আসেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। শুনানি শুরু হলে প্রথমেই চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আসামিপক্ষে সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী শুনানি করতে এসেছেন। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে যাচ্ছেন বলে জানতে পেরেছি। ২-১ দিনের মধ্যেই হয়তো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।’ এ সময় তাজুল ইসলাম তাঁকে আসামিপক্ষে শুনানি না করতে অনুরোধ জানান।

আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী তখন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি এখনও ফরমাল লেটার পাইনি। ফরমাল লেটার পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এ ছাড়া যে পদ আমাকে দেওয়া হবে, সেটি আমি গ্রহণ করি কিনা, তাও ভাববার বিষয়।’ এর পর তাঁর জুনিয়র আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু ট্রাইব্যুনালে শুনানি করতে এলে তাঁর কাছে যথাযথ আবেদন না থাকায় তিনি শুনানি করতে পারেননি। তিনি শুনানি করতে চান ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও মুহাম্মদ ফারুক খানের পক্ষে। শুনানির আগে বিচারকদের কাছে যে আবেদন দেওয়া হয়, সেটি না থাকার বিষয়টি চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন। আইনজীবী দুলু তখন ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আবেদন ছাড়া কি শুনানি করা সম্ভব?’ জবাবে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল চাইলে সম্ভব, যদি অনুমতি দেওয়া হয়, আমি শুনানি করতে চাই।’ ট্রাইব্যুনাল তখন তাঁকে শুনানি করতে নিষেধ করেন। পার কারণে এদিন কোনো আসামির পক্ষেই শুনানি হয়নি।

প্রসিকিউশনের শুনানি
সকাল ১১টা ১০ মিনিটে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ছাত্র-জনতাকে হত্যা, বিগত তিনটি নির্বাচনের নামে প্রহসন, পিলখানায় বিডিআর হত্যা, মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর গণহত্যা, সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আয়নাঘর তৈরির প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এ ছাড়া তিনি ১১১৯ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, আদালতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশ থেকে দুই লাখ কোটি টাকা পাচার, শেয়ারবাজার লুট, রাজাকার ট্যাগ দিয়ে দেশের মানুষকে পৃথক করা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ ইত্যাদি উল্লেখ করে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রীদের বিচার করার কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই, যেটা শেখ হাসিনা করেননি। আর উপস্থিত আসামিরা এসব অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেন।’ শেখ হাসিনার শাসনামলকে ফ্যাসিবাদের দুঃশাসন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হতো। মানুষ একটা সুযোগ খুঁজছিল। কোটা আন্দোলন, পরে গণআন্দোলনে রূপ নেয়।’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শেষ করতে ট্রাইব্যুনালের কাছে সময় প্রার্থনা করেন চিফ প্রসিকিউটর। ট্রাইব্যুনাল তখন জানতে চান ‘শেখ হাসিনা কোথায়? তাঁর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টের কী হলো?’ জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে ভারতকে অনুরোধ জানাবে সরকার।’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আসামিদের অপরাধ এতই জঘন্য যে, শুধু এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে গণহত্যা চালাতে দ্বিধা করেননি।’

তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে দেড় হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। গণহত্যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন নিজের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে।’

জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে ইন্টারনেট বন্ধ করায় বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। এ ছাড়া সাবেক বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ করেন।

চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালের কাছে সব প্রমাণ জমা দেওয়ার জন্য দুই মাস সময় চান। তবে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে এক মাস সময় দেন। এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে শেখ হাসিনাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেন। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনালে আগামী ১৭ ডিসেম্বর ‘সাবমিশন অব ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট’ দেওয়ার আদেশ দেন।

ট্রাইব্যুনালে যেমন ছিলেন আসামিরা
সকাল ১০টায় একাধিক প্রিজনভ্যানে ১৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। দীপু মনি ছাড়া ১২ জনকে একটি কক্ষে রাখা হয়। দীপু মনিকে রাখা হয় অন্য কক্ষে। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে আসামিদের এজলাসে আনা হয়। এ সময় হাসানুল হক ইনু, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে হাসিখুশি দেখা যায়। সালমান এফ রহমান তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। দীপু মনি অধিকাংশ সময় মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে বসে ছিলেন। কামাল আহমেদ মজুমদার তিন-চারবার দাঁড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তবে তাঁকে থামিয়ে দেন পুলিশ সদস্যরা। আনিসুল হক কয়েকবার তৌফিক-ই-এলাহীর সঙ্গে কথা বলেন। সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ কয়েক আসামির সঙ্গে কথা বলেন। ১২টা ৮ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শেষ হয়।

আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে অবৈধ ঘোষণা এবং শেখ হাসিনার নামে গণহত্যার মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঝটিকা মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। গতকাল রাজধানীর মৎস্য ভবন, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, পল্টন এলাকায় এসব মিছিল হয়।

রাজধানীর রমনা উদ্যানের পাশে সকাল ৭টার দিকে ব্যানার ছাড়াই ১৫-১২ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী একটি ঝটিকা মিছিল করেন। ঘণ্টাখানেক পর কাকরাইল ব্যাটারিগলিতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের আরেকটি মিছিল বের হয়। কাঁটাবন এলাকায় মিছিল করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ১০-১২ জন। পল্টন ও যাত্রাবাড়ীতে মিছিল করে মহানগর আওয়ামী লীগ। উত্তরায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আরেকটি মিছিল করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশের মুখে ছিল মাস্ক ও কাপড়ে ঢাকা।

সিলেট ব্যুরো জানায়, মুখে মাস্ক পরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ঝটিকা মিছিল করেছে একদল যুবক। সকাল ৯টার দিকে নগরীর পূর্ব দরগাহ গেট এলাকায় মিছিলটি দেখা যায়।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় থেকে বদনা শাহ মাজার পর্যন্ত ঝটিকা মিছিল করে একদল যুবক। পরে দু’জনকে আটক করে পুলিশ। তারা হলেন আইন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম দিদার ও ছাত্রলীগ কর্মী সজীব হোসেন।

অঅরো পড়ুন : আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিএনপির

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *