মার্কিন কেন্দ্রীয় কমান্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, মঙ্গলবার লোহিত সাগরের দক্ষিণে হুতি বিদ্রোহীরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, হামলায় তারা ইরানে তৈরি একমুখী হামলার ড্রোন, যাত্রীবাহী ও যুদ্ধজাহাজ রুখে দিতে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। উপরন্তু রাতে যুদ্ধ করার সক্ষমতার প্রমাণস্বরূপ হুতিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে আনুমানিক রাত সোয়া ৯টায় হামলাটি চালিয়েছে। ওই বিবৃতি অনুযায়ী, অঞ্চলটিতে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ সামরিক সরঞ্জাম ঘাঁটির আশপাশে হুতিদের নিক্ষিপ্ত ১৮টি ড্রোন, জাহাজ বিধ্বংসী দুটি ক্রুজ মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করেছে।
এদিকে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ‘কঠোর ভাষায়’ ওই হুতি আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে। নিঃসন্দেহে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে হুতিরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ওই প্রস্তাব গ্রহণে যে ধরনের তৎপরতা দেখিয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠানটির দ্বিচারিতা প্রকাশ পেয়েছে। স্মর্তব্য, নিরাপত্তা পরিষদ গাজা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে তারা ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানাতে পারত। ইতোমধ্যে এই ধ্বংসযজ্ঞ ৯০ দিনের বেশি হতে চলেছে। এতে ২৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ১০ হাজার লোক আহত হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক বসতভিটা হারিয়েছে।
গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অক্টোবরে হুতিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে হামলাগুলো ব্যর্থ হলেও, সশস্ত্র বাহিনীটি ইয়েমেনসহ অন্যান্য অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যেহেতু তারা ইসরায়েলি নৃশংসতায় বিধ্বস্ত গাজাবাসীর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। লোহিত সাগরের ইসরায়েলি বাণিজ্যিক জাহাজগুলো হুতিদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে যেখানে আন্তর্জাতিক তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল না, সেখানে হুতি বাহিনী এভাবেই ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছিল। এরই মধ্য দিয়ে গাজা যুদ্ধ আরও বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। তার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় মানবিক সহযোগিতা উন্মুক্ত না করে দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানি হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তাদের এহেন হামলা ও সতর্কবাণীর কারণে অনেক কোম্পানি নিজেদের জাহাজগুলো কেপ অব গুড হোপের আশপাশ ও আরও দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে জাহাজ কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে গেছে এবং বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন হুমকির মুখে পড়েছে।
১৯ নভেম্বর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর ২৬ বার আক্রমণ চালিয়েছে, যদিও তারা জাহাজগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কী সম্পর্ক, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। তবে এই সপ্তাহের বৃহৎ আকারের আক্রমণ ও ধারাবাহিক হামলার মধ্য দিয়ে তারা প্রকাশ্য বার্তা দেয়– তাদের এ প্রতিরোধ চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৪টি দেশের দেওয়া যৌথ বিবৃতির এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে মঙ্গলবারের হামলাটি ঘটেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, লোহিত সাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথে উন্মুক্ত বাণিজ্যিক লেনদেনের বৈশ্বিক অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত করা ও জীবন সংকটাপন্ন করে তোলার জন্য হুতি বিদ্রোহীরা দায়ী থাকবে।
ইতোমধ্যে হুতিদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও অন্যদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সতর্কবার্তা ও নিষেধাজ্ঞার পরও তারা হামলা বন্ধ করার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।
রাজনৈতিকভাবেও দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এতে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে। বুধবার জারি করা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকেও তারা পাত্তা দেবে বলে মনে হচ্ছে না। সুতরাং জাতিসংঘও হুতিদের থামাতে পারছে না। অতীতে ইয়েমেন সংঘাতকালেও হুতিরা প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে।
এটা ঠিক, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর হুতিদের আক্রমণ বন্ধের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চলমান সংকটের বাইরে গিয়ে আরও সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে। এই জটিল সমস্যাটি নিরসনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ তুলে ধরছি।
প্রথমত, ইয়েমেনিদের সঙ্গে জাতিসংঘ, সৌদি আরবসহ ওমানের মধ্যস্থতায় চলমান শান্তি মিশন সফল করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সে দেশে বিপুল পরিমাণ সহায়তা প্রদান করা। জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য একটি পথরেখা তুলে ধরেছেন। এই প্রস্তাবে হুতিদের সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও জাহাজের ওপর রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ কমানোর কথাও যুক্ত করা যায়।
দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের প্রস্তাবটি কার্যকর করে লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল পরিবহন বন্ধ করতে সেখানে সদ্য মোতায়েনকৃত সামরিক সরঞ্জাম কাজে লাগানো যেতে পারে।
তৃতীয়ত, জিবুতির পাশাপাশি হুদেইদাহ বন্দরেও দায়িত্ব পালনের এখতিয়ার দিয়ে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের (ইউএন ভেরিফিকেশন অ্যান্ড ইন্সপেকশন মেকানিজম ইন্সপেক্টরস) ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত। তাদের সেখানে নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য এটাই ছিল।
চতুর্থত, জাহাজের ওপর আসন্ন আক্রমণের আগেই সংকেত জানানোর উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনী তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারে। পঞ্চমত, সমুদ্রে হুতিদের মোতায়েনকৃত বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো সরানোর ব্যবস্থা করা। ষষ্ঠত, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে, ইয়েমেনের উপকূলীয় রক্ষীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান এবং সে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অক্ষুণ্নতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ইয়েমেন সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের আগের প্রস্তাবে উপর্যুক্ত পদক্ষেপের পাশাপাশি অন্যান্য পদক্ষেপও যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে হুতিরা জলপথের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পেরেছে। এখন সেগুলো বাস্তবায়নের সময়।
ড. আবদেল আজিজ আলুওয়েইশেগ: গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের রাজনৈতিকবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল; আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
সুত্র; সমকাল
আরো পড়ুন : জবুল্লাহ বড় রকম রাজনৈতিক শক্তি, তাই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে