সরকারি চাকরিতে কোটা প্রত্যাহারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় ঘটে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। ব্যাপক প্রত্যাশা আর জন-আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার সমর্থন নিয়ে তিন দিন পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হলো। গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের যে ‘জনপ্রত্যাশা’ তৈরি হয়েছে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এই সময়ে সেটি পূরণ করতে পেরেছে কি না, সেই হিসাব মেলাচ্ছেন অনেকেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই ১০০ দিনে যা করেছেন: আন্দোলনে নিহত শহীদদের বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু, শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তায় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন; সংবিধান, বিচার, জনপ্রশাসন, পুলিশসহ ১০টি খাতে সংস্কার কমিশন গঠন; পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো; গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর এবং আয়নাঘরের রেপ্লিকা স্থাপনের নির্দেশ; আর্থিক খাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত, বিচারের উদ্যোগসহ বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তবে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি এই ১০০ দিনে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, দ্রব্যমূল্য সামাল দেওয়া এবং ব্যবসাবাণিজ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই ১০০ দিনে যা করতে পারেননি: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও এখনো তৃণমূল পর্যায়ে থানাগুলো কার্যকর করা যায়নি। অনেক থানায় প্রয়োজনীয় লোকবল নাই। এমনকি অস্ত্রের অভাবও রয়েছে। কিছু কিছু থানায় কাগজপত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে মনোবল হারানো পুলিশ বাহিনী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বেড়েছে ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি ও হত্যার ঘটনা।
মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগগুলোতে যে সকল সমস্যা: আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি জনপ্রশাসনেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। গণ অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগগুলো থেকে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার বঞ্চিতদের ক্ষোভ মেটাতে ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে করে প্রশাসনের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত পিরামিডস্বরূপ যে পদবিন্যাস ছিল সেটি ভেঙে গেছে। যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মকর্তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলেও উপসচিব ও তার নিচের দিকে কর্মকর্তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিগত সরকারের আমলে বঞ্চিত অনেকে আবার কাক্সিক্ষত পদ পাননি। অনেক কর্মকর্তাকে অবসরোত্তর ছুটি থেকে ফিরিয়ে এনে নতুন ও শীর্ষ দায়িত্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে হিসাব মিলছে না প্রশাসনের নিয়মিত কর্মকর্তাদের।
তাছাড়া অভ্যুত্থানে সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়ায় সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সরকারের কিছু উপদেষ্টার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে উপদেষ্টা নিয়োগে একটি প্রশাসনিক বিভাগের আঞ্চলিকতা নিয়ে। নতুন করে তিন উপদেষ্টা নিয়োগসহ বেশ কিছু ইস্যুতে দূরত্ব দেখা দিয়েছে সরকারের বাইরে থাকা ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গেও। এমনকি আন্দোলনে আহত ও হাসপাতালে চিকিৎসারত ছাত্র-জনতার মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ। তারা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। আহত আন্দোলনকারী অনেকের অভিযোগ, তারা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাদের চিকিৎসায় যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, সেটিও তারা পাননি। তাদের হিসাবও মিলছে না।
শুধু যে গণ অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের হিসাব মিলছে না তাই নয়; হিসাব মিলছে না আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কদেরও। তাদের দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক ঐকমত্য স্থাপন করতে পারেনি সরকার। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারে নতুন করে তিন উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়েও সরকারের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের। তারা মনে করছেন, কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নতুন তিন উপদেষ্টা নিয়োগকে ‘জাতির সঙ্গে মশকরা’ বলে উল্লেখ করছেন। একই সংগঠনের সংগঠক ও নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগে আঞ্চলিকতার অভিযোগ তুলে উল্লেখ করেছেন, ‘শুধু একটা বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই! তার ওপর খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে!’
শুধু যে ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়ায় সংকট তৈরি হয়েছে তা নয়, আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নানা ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে চাইলেও সেটি এখনো স্পষ্ট করেনি সরকার। স্পষ্ট হয়নি গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রম। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে স্পষ্ট হয়নি তা-ও। সংবিধান পরিবর্তন, নির্বাচনসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু সংস্কার বিষয়ে বিএনপি নিজেদের বিরক্তি গোপন রাখেনি। অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিলেও সংস্কার কার্যক্রম যে একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি নির্বাচিত সরকারের কাজ, সেটি বিএনপিসহ আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা স্পষ্ট করেছেন। তারা দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতির হিসাবও মিলছে না।
আবার রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণেও স্বস্তিতে নেই অন্তর্বর্তী সরকার। হাজারো শিক্ষার্থীর রক্তের বিনিময়ে যে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেই দাবি মেটাতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রমে হাত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টারা চাইছেন, এই সংস্কারকাজে দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করবে। তবে সেই চাওয়া যে পূরণ হচ্ছে না, তা এই ১০০ দিনে স্পষ্ট হয়েছে।
সেই পেক্ষিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের ত্যাগের চেতনা ধারণে ব্যর্থ হচ্ছে।’ এ অবস্থা চলতে থাকলে গণ অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
হিসাব মিলছে না ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তাদেরও। অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো শিল্পোদ্যাক্তাকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। কাউকে কাউকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর আস্থার সংকটে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। বড় উদ্যোগে সহায়তা করার সামর্থ্য নেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। শিল্পের জন্য নতুন ঋণ মিলছে না। এলসি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। অনেক ব্যাংক আমানত দিতে পারছে না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এখনো ভুগছে কারখানাগুলো। উৎপাদন কমে যাওয়ায় পুরনো ঋণ পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পেও চলছে শ্রম অস্থিরতা। কিছু কারখানা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না। আবার কিছু কারখানা বেতন পরিশোধ না করেই শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করছে। এর ফলে শ্রম অসন্তোষ বেড়ে গেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতা বিরাজ করছে। আর্থিক সংকট ও ব্যাংকে টাকা না থাকায় সরকারি প্রকল্পগুলো বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি খাতেও নির্মাণকাজে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ফলে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প-কারখানাগুলোও বিপাকে পড়েছে। তারা রড, সিমেন্টের দাম কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে; তবে সেই চেষ্টা কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আলমগীর কবির সম্প্রতি বলেন, রাজনৈতিভাবে দেশে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে বেসরকারি খাত খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে এখন নির্মাণকাজ করছে না। যারা শুরু করেছিলেন নানা অনিশ্চয়তার কারণে তারাও কাজ বন্ধ রেখেছেন। অপরদিকে মেগা প্রকল্পসহ বেশির ভাগ সরকারি প্রকল্প বন্ধ রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের অনেকে পালিয়ে যাওয়ায় মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায় নির্মাণকাজও বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
চাওয়াপাওয়ার হিসাব মিলছে না সাধারণ মানুষেরও। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অপরদিকে ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হওয়ায় জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। যারা মধ্যবিত্ত ছিলেন, তারা হঠাৎ করেই নিজেদের নিম্ন আয়ের মানুষ মনে করছেন। যারা দরিদ্র ছিলেন, তারা নিজেদের মনে করছেন হতদরিদ্র। খাবার বাবদ মাসখরচের টাকা, সন্তানের শিক্ষাব্যয়, বাসাভাড়া, যাতায়াত খরচ ও চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে দেখছেন হাতের টাকা মাসের মাঝামাঝিতেই শেষ। বাকি দিনগুলো চেয়েচিন্তে পার করতে হচ্ছে। কেউ কেউ টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরছেন, তবু হিসাব মিলছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন সরকারের হিসাবেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি (গত অক্টোবরে) বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, তখন নিম্ন আয়ের মানুষ এমনকি মধ্যবিত্তের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। গণ অভ্যুত্থানকে সমর্থন করা সাধারণ মানুষের এত হিসাবের দরকার নেই। তাদের হিসাব মোটাদাগে কিছু মৌলিক চাহিদা যেমন : খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল।
রাজধানীর মিরপুরে জুলাই আন্দোলনে আহত এক শিক্ষার্থীর বেসরকারি কর্মজীবী বাবা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কী হইব, না হইব- তা ভেবে পোলার সঙ্গে রাজপথে নামি নাই। আন্দোলন করছি ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য। সেইটার হিসাবই তো এখন মিলতেছে না…।’
অঅরো পড়ুন : ছাত্রদল ক্যাডারের নেতৃত্বে রূপগঞ্জে সাংবাদিক নির্যাতন