চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার সূচিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পূজা সরকার। তার বাড়ি বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলায়। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ পেয়ে যোগদান করেন চাকরিতে। কিন্তু মনে শান্তি নেই তার। স্বামী ও দুই ছেলের সঙ্গে থাকা হয় না তার। তিনি বলেন, তারা রান্না করে খায়, আবার হোটেলেও খায়, অনেক কষ্টে দিন যায়। যখন এগুলো শুনি কান্না চলে আসে। কিছু বলতে পারি না। বাচ্চাদের ছেড়ে থাকা যে একজন মায়ের জন্য কতোটা কষ্টের তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আবার চাকরিটা যে ছাড়বো তাও পারি না।
তিনি বলেন, আমি কর্মস্থলে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে থাকি।
তার জীবনের শান্তিটাও নষ্ট করে দিয়েছি। বাবা, দুই ছেলে, স্বামী সবাই কষ্ট করছে আমার জন্য। কর্মস্থল থেকে বাড়িতে যাওয়া-আসার ভাড়া লাগে ১৫০০ টাকা। বাবাসহ বাড়ি যেতে এমনি অবস্থা হয় যে, বাচ্চাদের জন্য কিছুই নিয়ে যেতে পারি না। যা বেতন পাই বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে সবকিছু কষ্ট করে চালাই। আমারই চলে না দিনশেষে ছেলেদের জন্য তো দূরের কথা।
পূজা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে চাকরি। কি করে এত অল্প বেতনে করি। তারপরও খুব দ্রুত বদলি ব্যবস্থা কিংবা ইনডেক্সধারীদের জন্য বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি চালু না করলে আমরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। চাকরি করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাই বলে নিজ এলাকা ছেড়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে চাকরি করার ইচ্ছা কোনোদিনও ছিল না। আমারওতো সংসার করতে হবে এই বছরটাই দেখে তারপর যদি বদলি না হয় তাহলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে।
পূজার মতো লাখো শিক্ষক অপেক্ষা আছেন নিজ এলাকায় যাবার জন্য। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি প্রথা না থাকায় চাপা আর্তনাদ নিয়ে চাকরি করছেন পাঁচ থেকে ছয় লাখ শিক্ষক। বদলির দাবিতে করছেন আন্দোলন। কিন্তু নির্বিকার প্রশাসন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির কোনো ব্যবস্থা নেই। পূর্বে শিক্ষকরা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। তবে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ বন্ধ করায় শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
সুবর্ণা খাতুন বলেন, আমি চাকরি করি। বেতন মাত্র ৯ হাজার ৭০০ টাকা। আমার বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদীতে। আমি চাকরি করছি শরীয়তপুর ভাসান চর আলিম মাদ্রাসায়। আমার স্বামী থাকেন ঢাকায়। এই টাকায় আমার নিজের চলাটাই কষ্টসাধ্য। স্বামী এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। আমার ছোট বাচ্চা আছে এক বছরও হয় নাই। একটাবার চিন্তা করেন পরিবার ছাড়া ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে চাকরি করাটা আমার জন্য কতোটা কষ্টসাধ্য।
সিলেটে চাকরি করেন মো. ফখরুল ইসলাম। তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলায়। তিনি বলেন, ১২ হাজার ৭৫০ টাকায় চাকরি করি। এ টাকা দিয়ে নিজের চলাটাই কষ্টসাধ্য। পরিবারকে কি পাঠাবো? চাকরি করি কিন্তু ছেলে-মেয়ের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি না। পড়াতে পারি না একটা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আমি চাকরি করেই যেন অসহায় হয়ে গেছি। ছেলে-মেয়েদের ঠিকমতো পাশে দাঁড়াতে পারি না। মা-বাবার কাছেও ছোট হয়ে গেছি।
জামালপুর কলেজের প্রভাষক (সমাজকর্ম) পদে কর্মরত আছেন শাকিলা আক্তার। তার বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি বলেন, আমার মেরিট পজিশন ছিল ১৪। আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ঢাকার কোনো কলেজের প্রভাষক হবো। শিক্ষকতা পেশায় আমি ঘটনাচক্রে আসিনি বরং আমার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করার জন্য এসেছি। ২০১৬ সালে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করিনি কারণ আমার উপজেলায় কোনো পোস্ট খালি ছিল না। আমার পরিবার ঢাকায় থাকে তাই ইচ্ছে ছিল ঢাকার কোনো কলেজে চাকরি করবো। ২য় গণবিজ্ঞপ্তিতে ঢাকায় মাত্র ৪টি পোস্ট খালি ছিল। আমার মেরিট পজিশন অনুযায়ী এনটিআরসিএ আমাকে সুপারিশ না করে দূরের মেরিট পজিশনদেরকে সুপারিশ করেছিল তাই ২য়তে আমার ঢাকায় চাকরি হয়নি। আমার ছেলে ছোট্ট ছিল তাই তখন এনটিআরসিএ অফিসে গিয়ে অভিযোগ করিনি। ৩য় গণবিজ্ঞপ্তিতে সারা বাংলাদেশে সমাজকর্মে মাত্র ৬টি পোস্ট খালি ছিল। ঢাকায় কোনো পোস্ট খালি না থাকায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ কলেজে আবেদন করে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করেছি। তখন ভেবেছিলাম যেহেতু আমার মেরিট পজিশন খুব কাছে তাই ৪র্থতে আবেদন করে ঢাকায় চলে যাবো। কিন্তু ১৪ই নভেম্বর ২০২২ তারিখটি আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের খবর নিয়ে আসে। সেদিন এনটিআরসিএ এর নিয়োগ পরিপত্র ২০১৫ এর ৭নং ধারা সাময়িক স্থগিত করা হয়। ফলে ইনডেক্সধারীরা আবেদনের সুযোগ হারায়। প্রথমদিকে ঢাকা থেকে আসলেও এখন কলেজের কাছাকাছি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। ছেলেকে নিয়ে একা থাকি। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকি।
ভূপেন্দ্র নাথ রায়ের বাড়ি দিনাজপুরে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পান। তিনি বলেন, ভাবছিলাম সন্তানদের উন্নত জীবনসহ ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করাবো। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝি একজন শিক্ষক গ্রামে যত টাকা বেতন পায়, ঢাকা শহরেও তাই। যখন দেখি ১টি সাবলেট ঘরে ভাড়া নিতে গুনতে হয় ৮-১২ হাজার টাকা। একজন দশম গ্রেডের শিক্ষক যে টাকা পায় তা এই ব্যয়বহুল শহরে ১টি পরিবার চালানো কতো কঠিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম। আবার সেখানে প্রতিষ্ঠান থেকে যদি সাপোর্টই পাওয়াও দুর্লভ হয় তাহলে স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যায়। এখন আমাকে ৩টি পরিবার দেখতে হয়, আমি নিজে, গ্রামে স্ত্রী -সন্তান, সন্তানের পড়াশোনা, অসুখ-বিসুখ এবং বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধ ও হাত খরচ। তারপরও ভেবেছিলাম ৪র্থ গণবিঞ্জপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে থাকার। কিন্তু একটি সাময়িক পরিপত্র সে পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পিতাহীন সন্তানরা যে অনিরাপদ এবং অসহায়ভাবে বেড়ে ওঠে তা আমার সন্তানদের দেখলে মনে হয়। বাবা-মা কাঁদতে না পারলেও চাকরিতে ফেরার পথে দেখি চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে। তিনি বলেন, আমি শিক্ষামন্ত্রী, সচিব মহোদয়, এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক বলতে চাই, যেহেতু বদলি একটি জটিল প্রক্রিয়া, সেহেতু এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বিভিন্ন জেলায় শিক্ষকদের আলাদা গণবিজ্ঞপ্তিতে কিংবা সাময়িক স্থগিতাদেশ পরিপত্রটি বাতিল করে পুনরায় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ দিলে আলাদা কোনো বাজেট, পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ অনেকের পদায়ন সহজ হবে।
বদলির দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালতের শরণাপন্নও হয়েছিলেন তারা। ২০২১ সালের ২রা জুন ১৩০ শিক্ষকের দায়ের করা রিটের বিপরীতে বদলির বিষয়ে পদক্ষেপের জোর দেন আদালত। এতে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে পারবে। আবার সেই বছরের ২৮শে মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলির ব্যবস্থা রেখে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি করে। এতে বলা হয়, এনটিআরসিএ এর সুপারিশে নিয়োগ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠান শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সম স্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।
জানা যায়, এনটিআরসিসএ’র কাছে যেহেতু এসব শিক্ষকের তথ্য আছে সেহেতু তারা সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বদলি কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। এজন্য তারা লিখিত আকারে মন্ত্রণালয়েও চিঠি পাঠায়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই কার্যক্রমটি থমকে থাকার পেছনেও বেশকিছু কারণ আছে। যেমনÑ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র, আলাদা ধরণ ও মানের পরিবর্তন থাকায় এটি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েও সুফল আসেনি। এ ছাড়াও পরিচালনা কমিটি আলাদা শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ভিন্নতা, বেতনভাতা ও পদোন্নতি নিয়েও আলোচনার টেবিলে জটিলতা দেখা দেয়। এরপর করোনার কারণে এতে চলে আসে ধীরগতি। খাতা-কলমে ও টেবিলের দ্বিমতের কারণে শিক্ষকদের দুঃখগাথা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
বদলির জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষক মাহবুব ইসলাম বলেন, আমরা গত ৩টি গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইনডেক্সপ্রাপ্ত হয়েছি। তবে হঠাৎ করে ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের বদলীর কোনো সুযোগ নেই। একটিমাত্র সুযোগ ছিল সেটি হলো গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের মাধ্যমে নিজ বাড়ির কাছে যাওয়ার। এখানে আমরা মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করেই যেতাম। তবে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন হটকারী সিদ্ধান্তের কারণে লাখ লাখ শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা না বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেহেতু আমাদের বদলীর কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই বদলী ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের আবেদনের সুযোগ দিতে হবে। আবেদনের সুযোগ না দেয়া হলে আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি আটকে দেবো। আমরা সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কারণে নিজ বাড়ি থেকে অনেক দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। তাহলে এখন আমাদের প্রশ্ন, তাহলে এখন কেন পারবো না? আবার প্রাথমিক শিক্ষকদেরও বদলি কার্যক্রম চলছে তবে আমাদের দোষটা কোথায়?
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বেসরকারি মাদ্রাসার শিক্ষকদের যাবতীয় বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। পূর্বের এমপিও নীতিমালায় শিক্ষকদের বদলির কথা বলা হলেও সংশোধিত এমপিও নীতিমালায় এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এর ফলে শিক্ষকদের বদলির পথ আরও কঠিন হয়েছে। শিক্ষকদের সমপদে পারস্পারিক বদলির যে গুঞ্জন উঠেছে সে বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই।
এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এই বিষয় নিয়ে কাজে হাত দিলেই নানা ধরনের জটিলতার মুখে পড়তে হয়। কারণ প্রতিষ্ঠানের মানের বিষয়টি প্রথম বিবেচ্য বিষয়। আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের যেহেতু স্ট্যাকচারাল এলিমেন্ট ভিন্ন তাই এই বদলি নিয়ে এগুনো মুশকিল। আবার বদলি শুরু হলে দেখা যাবে হাওর বা দুর্গম এলাকার শিক্ষকরা সেখানে চাকরি করতে চাইবেন না। তিনি প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারা এনটিআরসিএ’র মেধা তালিকার মাধ্যমে বদলি কার্যক্রম করতে চান। এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হবে। তবে প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম এগুচ্ছে কম।
আরো পড়ুন : বরিশাল সিটি নির্বাচনে গাজীপুরের পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় ভুগছে আওয়ামী লীগ