১৭০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিল ২০ প্রতিষ্ঠান

অনুসন্ধানী অর্থনীতি আইন-আদালত জাতীয় তথ্য-প্রযুক্তি দুর্নীতি প্রচ্ছদ মুক্তমত শিল্প প্রতিষ্ঠান হ্যালোআড্ডা

বিভিন্ন কৌশলে ১৭০ কোটি টাকার বেশি কর ফাঁকি দিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ২০টি প্রতিষ্ঠান। অনুমোদন ছাড়া এবং অনুমোদন সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু আয় নিরূপণের ক্ষেত্রে কৌশলে এসব ব্যয়কে গোপন রাখা হয়েছে।

সরকারের বিপুল অঙ্কের এই কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাটি একাদশ জাতীয় সংসদের ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির’ বৈঠকে উঠে আসে। এই টাকা দ্রুত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে। কিন্তু অদ্যাবধি সেই অর্থ জমা হয়নি। এছাড়া বাকি নয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আপিল বিভাগে মামলা হওয়ায় বিচারাধীন আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। যে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আগ্রাবাদ কর সার্কেল চট্টগ্রাম অফিস (প্রায় ৫৭ লাখ টাকা), কুমিল্লা সার্কেল অফিস (৮০ লাখ টাকা) এবং কাস্টম হাউজ বেনাপোল (৫ কোটি টাকা)। আর কর ফাঁকির ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আপিল বিভাগে যে ১৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে (৭ কোটি ২২ লাখ টাকা), ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লি. (১ কোটি ২২ লাখ টাকা), নিউজিল্যান্ড ডেইরি প্রডাক্টস (৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা), মদিনা সিমেন্ট (৯৭ লাখ টাকা) এবং গুলশান কর রাজস্ব সার্কেল অফিস (প্রায় ১৯ কোটি টাকা)। কর আদায় প্রসঙ্গে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারাধীন, সেক্ষেত্রে রায়ের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গৃহীত ব্যবস্থার প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা অধিদপ্তর এবং সিএজি কার্যালয়ের মাধ্যমে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে অবহিত করতে বলা হয়।

সূত্রমতে, কর ফাঁকির ঘটনাগুলো শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিস। শনাক্তের পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বাভাবিক পন্থায় অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়। এরপর সেগুলো রিপোর্ট আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন হলে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয় সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে। ওই কমিটি ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে কর ফাঁকির সত্যতা খুঁজে পায়। এরপর প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপমহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. আহসান হাবীব বলেন, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এসব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জড়িতদের অর্থ ফেরত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত অর্থ জমা দেওয়া হয়নি। তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনার বিপরীতে রিপোর্ট ধরে অর্থ আদায় সম্ভব না হলে আইনি ব্যবস্থা অর্থাৎ মামলায় যেতে হয়। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। যা এখন বিচারাধীন।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডোনেশন এবং সাবক্রিপশন বাবদ ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ের দাবি করেছে। কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশের ১৯৮৪-এর ২৯ ধারা মতে উপহার বা চাঁদা বাবদ খরচ বিয়োজন অনুমোদনযোগ্য নয় বিধায় মোট আয়ের সঙ্গে যোগ করতে হয়। এছাড়া দাবিকৃত খরচ থেকে ১২ শতাংশ উৎস কর কর্তনযোগ্য। সংসদীয় কমিটি এ ঘটনা পর্যালোচনা করে দেড় মাসের মধ্যে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র নিরীক্ষা অধিদপ্তরে এবং সিএজি কার্যালয়ের মাধ্যমে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে জানাতে বলা হয়।

একইভাবে দেখা গেছে, কর্মীদের বোনাস এবং অনুদান প্রদান বাবদ ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় দেখায় অপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই ব্যয়ের মধ্যে ৪০ কোটি ৯ লাখ টাকা আয়কর অধ্যাদেশের অনুমোদনযোগ্য নয়। যে কারণে এটি আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এই ঘটনা পর্যালোচনা করেছে। এরপর ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে তার প্রমাণ সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা অধিদপ্তরে এবং সিএজি কার্যালয়ের মাধ্যমে কমিটিকে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

নথি পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, আমদানিকারকের কাছ থেকে আগাম কর আদায় করেনি গুলশান সার্কেল অফিস। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ অনুযায়ী নিবন্ধিত আমদানিকারক ভিত্তি মূল্যের ৫ শতাংশ হারে আগাম কর পরিশোধ করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমদানিকারকের কাছ থেকে আগাম কর আদায় না করে হ্রাস করে দেওয়া হয়। এ ঘটনাটি আলোচনার পর দেখা গেছে সার্কেল অফিসের এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রায় ১৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে সরকারের। ফলে ওই বৈঠকে এই টাকা সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের কাছ থেকে আদায় করে কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি এ ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুশাসন দেওয়া হয়।

এদিকে গ্রামীণফোনে অনুমোদন ছাড়া ব্যয় আয়ের সঙ্গে যোগ না করে মোট আয় নিরূপণ করেছে। এতে ৭ কোটি ২২ লাখ টাকার কর ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনাটি রাজস্ব বোর্ডের আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়ে। ওই কমিটির বৈঠকে এ ঘটনায় আপিল কর্তৃপক্ষের রায়ের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলো তার প্রমাণসহ কমিটিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

আরো পড়ুন : শহরের অচেনা মাদক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পরায় ধ্বংসের পথে এক প্রজন্ম

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *