ইলেক্ট্রিক ব্যবসায়ী সবুজ। ১০ বছর ধরে ভালোই চলছিল তার ব্যবসা। গত মাসে বন্ধুর কথায় তিনি এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন ২০ লাখ টাকার মতো। বিনিয়োগের পর শুধু লাভের আশায় থেকেছেন। গত ১৬ই আগস্ট এমটিএফই’র অ্যাপ্স বন্ধ হয়ে যায়। তার বুঝতে বাকি নেই যে, তিনি বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সবুজের মতো নিঃস্ব শত শত গ্রাহক এখন সিআইডি’র হটলাইনে ও স্বশরীরে লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন। টাকা পয়সা সব খুইয়ে কেউ সিআইডি কার্যালয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত চান। এর সঙ্গে জড়িত এমটিএফই’র সিও ও কর্তাব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুরোধ করেছেন।
এমটিএফইতে প্রতারণার খবর চাউর হওয়ার পর সিআইডি’র পক্ষ থেকে গত ২৫শে আগস্ট একটি হটলাইন নম্বরে তথ্য দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
গত ৫ দিনে ২৫২ জন গ্রাহক সিআইডি’র কাছে অভিযোগ করেছেন যে, এমটিএফইতে তারা বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কোনো কোনো গ্রাহক ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। আবার কেউ বিনিয়োগ করেছেন ২ থেকে ১০ লাখ টাকা। সিআইডি প্রাথমিক তদন্তে অফিসিয়ালি জানিয়েছে যে, দুবাইভিত্তিক প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছে বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ লোক এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে র্যাব জানিয়েছে, সারা দেশে এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ লোক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সিআইডি’র কাছে যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের অভিযোগ তদন্ত করছে সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টার শাখা।
এ বিষয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানান, ‘এমটিএফইতে যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের তথ্য দেয়ার জন্য একটি হটলাইনে নম্বর দেয়া হয়েছিল। এই পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জনেরও অধিক প্রতারিত গ্রাহক তথ্য দিয়েছে। যারাই প্রতারিত হয়েছে তাদের বলবো আপানারা তথ্য দিয়ে সিআইডি’কে সহযোগিতা করুন।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, দেশে লাখ লাখ গ্রাহক এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হলেও পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে যাচ্ছেন না। কারণ বাংলাদেশে ক্রিপ্ট কারেন্সি অবৈধ। বিটকয়েনে বিনিয়োগ করে আইনে ঝামেলায় পড়তে পারেন এজন্য তারা সিআইডিসহ আইনাশৃঙ্খলাবাহিনীর অন্যান্য সংস্থার কাছে অভিযোগ করতে যাচ্ছেন না। এতে দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত চতুরতার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, অন্যান্য দেশ যেমন- ভারত, জার্মানি, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ইতালিসহ ২৫টি দেশে ৭ কোটি মানুষকে তাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে। সিআইডিতে অভিযোগ দিতে আসা আশরাফুল ইসলাম নামে এক প্রতারিত গ্রাহক জানান, তিনি যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা। করোনায় তার চাকরি চলে যায়।
তিনি আরও জানান, তার বাসাভিত্তিক খাবার সরবরাহের একটি ব্যবসা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তার ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিছু টাকাও ব্যাংকে জমা হয়েছিল। ওই টাকা যাতে খাটিয়ে লাভ পাওয়া যায় এজন্য তিনি ৬ লাখ টাকা ডলারে রূপান্তরিত করে তিনি এমএফটিইতে বিনিয়োগ করেন। গত ১৬ই আগস্ট ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়। এতে তিনি দিশাহারা হয়ে গেছেন।
শহীদ নামে আরেক গ্রাহক জানান, তার এক বন্ধু এই প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করে কয়েক মাসের মধ্যে ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনেছে। তিনিও প্রায় ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু, কোনো লাভ পাননি। কয়েকদিন ধরে পত্রিকায় লেখা দেখার পর তিনি সিআইডিতে তথ্য দিতে এসেছেন। তিনি আরও জানান, তার বন্ধুর মাধ্যমেই তিনি এমএফটিইতে বিনিয়োগ করেছেন। তার বন্ধু এখন লাপাত্তা। আমাদের ধারণা, তার বন্ধু অ্যাপে টাকা জমা না দিয়ে ফ্ল্যাট ও জমি কিনেছে।
আশিকুল নামে আরেক গ্রাহক কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, অনেকটা বাধ্য হয়ে তিনি সিআইডিতে অভিযোগ দিতে এসেছেন। কারণ তার ব্যবসার সব টাকা তিনি এখানে বিনিয়োগ করেছেন। সিআইডি জানিয়েছে, অনেক গ্রাহক হটলাইনে অভিযোগ দেয়ার চাইতে স্বশরীরে এসে অভিযোগ করছেন। ভুক্তভোগীদের তথ্য নেয়ার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত এমএফটিইদের সিওদের তথ্য নেয়া হচ্ছে।
সিআইডি জানিয়েছে, দেশ থেকে যে ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে তা উদ্ধার করা তাদের পক্ষে অনেক কঠিন হবে। তবে যে সব সিওরা তাদের কাছে টাকা নিয়ে প্রতারণা করেছে তাদের কাছে অর্থ উদ্ধার করা যাবে।
আরো পড়ুন : বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন