স্টাফ রিপোর্টার : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। একইসঙ্গে এই সময়ের মধ্যে তাকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিননামা দাখিল করতে বলা হয়েছে। সকালে হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করেন মতিউর রহমান। বেলা ৩টা ১৪ মিনিটে প্রথম আলো সম্পাদকের উপস্থিতিতে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। আদালতে মতিউর রহমানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল, এডভোকেট জেড আই খান পান্না, প্রশান্ত কর্মকার ও জামিউল হক ফয়সাল। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি।
শুনানিতে প্রথমে ফিদা এম কামাল আদালতকে বলেন, মতিউর রহমান একজন সম্মানিত সিনিয়র সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা সঠিক নয়। বিষয়টি অন্য একজন সাংবাদিক পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে রিপোর্টটি করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছেন। প্রথম আলোর রিপোর্টে কোনো ভুল ছিল না।
ভুল করে অন্য একটি ছবি গেছে এবং কিছুক্ষণ পরেই সেই ছবি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে এভাবে হ্যারাজমেন্ট করার মানে হয় না। তিনি আদালতকে বলেন, প্রথম আলোর অনলাইনে দিনমজুরের উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছিল, সেখানে শিশু সবুজের কোনো নাম ছিল না। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, সে সময় বাসন্তীর জন্য কেউ কিন্তু এগিয়ে আসেনি। আর এ ক্ষেত্রে তিনি যে মামলাটি করেছেন তিনি কীভাবে এখানে সংক্ষুব্ধ হলেন, সেটাই তো বুঝলাম না। এরপর আদালত প্রথম আলোর আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রথম আলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে। আপনারা যদি এমন ভুল করেন, তাহলে চলবে কীভাবে। জবাবে মতিউর রহমানের আইনজীবী বলেন, এটি প্রথম আলো ভুল করেনি। এরপর আইনজীবী জেড আই খান পান্না আদালতকে বলেন, আমরা যার পক্ষে আদালতে শুনানি করেছি তিনি বাংলাদেশের একজন সিনিয়র খ্যাতনামা সম্পাদক। তিনি একতা পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। যে রিপোর্টের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেই মামলার কোনো ভিত্তি নেই। ভুল হওয়ার ১৭ মিনিটের মধ্যে রিপোর্টের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সংশোধনীও দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের সম্মান এত ছোট বিষয় নয়।
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি আদালতকে বলেন, একতা পত্রিকা আমরাও পড়েছি। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ইত্তেফাক এক একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রথম আলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিনে কী নিউজ করেছেন। ৭ বছরের সবুজকে টাকা দিয়ে তারা নিউজ করেছে। মাই লর্ড এটি মিথ্যা না। দেশের ক্ষতি করে তারা নিউজটা প্রত্যাহার করেছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিউজটি করা হয়েছে। এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী আদালতকে বলেন, প্রথম আলো কি সত্যের পক্ষে। এত দেখি মিথ্যার পক্ষে। প্রথম আলোর কাছে আমরা কি এই আশা করি। তারা ভুল করলেন, আবার প্রত্যাহার করলেন। বিষয়টি এমন যে পকেট মেরে আবার টাকা ফেরত দিলেন। আমি নিজেও প্রথম আলোর পাঠক। প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের পত্রিকা। কিন্তু এসব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কী কাজটি প্রথম আলো করলো? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেখানে টালমাটাল সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ৭ বছরের একটি বাচ্চা সবুজের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছে। পরে এটি প্রত্যাহার করলেও যা ক্ষতি করার তারা তা করে দিয়েছে। সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তখন আদালত বলেন, যেহেতু তারা একটি সংশোধনী দিয়েছে। আর আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সবার রয়েছে। তাছাড়া বাদী প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারতেন। পরে আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাটিতে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। একইসঙ্গে এই সময়ের মধ্যে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিননামা দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ২৯শে মার্চ মধ্যরাতে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। রমনা থানায় করা এই মামলায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভারে কর্মরত) শামসুজ্জামান, সহযোগী ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। মামলায় শামসুজ্জামান কারাগারে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্ধৃত করা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো।” এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্ট ও খবরের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। প্রতিবেদনে ওই উক্তিটি আরেক ব্যক্তির হলেও শিশুটির ছবির বিভ্রান্তি তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। পরে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ পোস্টটি সংশোধন করলেও এই খবরটিকে মিথ্যা ও রাষ্ট্রবিরোধী উল্লেখ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী আবদুল মালেক, যিনি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি।
আরো পড়ুন : সংশোধন হতে পারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বাতিল নয় : আইনমন্ত্রী