বিশেষ প্রতিনিধি: প্রাণে বাঁচতে অবৈধপথে ভারতে পালায় স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়া (৪৭) হত্যার সঙ্গে জড়িতরা। বিশেষ এক ধরনের অ্যাপসের মাধ্যমে সমকামীদের টার্গেট করে এই চক্রটি। ওই অ্যাপসে অনেক দিন ধরেই অ্যাকাউন্ট ছিল ইমতিয়াজের। একান্তে সময় কাটানোর প্রলোভন দেখিয়ে ও ফাঁদে ফেলে তাঁকে রাজধানীর কলাবাগানের বাসায় ডেকে নেয় তারা। পরে অর্থ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই চক্রের হাতেই খুন হন তিনি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে এসেছে এমন ভয়ংকর তথ্য।
তিন জেলায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলো- মিল্লাত হোসেন মুন্না ওরফে মুন (১৯), এহসান ওরফে মেঘ (২৩) ও আনোয়ার হোসেন (৩৮)। পলাতক আরাফাত ওরফে ফয়সাল ও আলিফকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার একটি গ্যারেজ থেকে হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। ভারতে পলাতক দু’জনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ চলছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত চক্রটি সমকামী ডেটিং অ্যাপের ফাঁদে ফেলে অনেক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তেজগাঁও এলাকায় নিজ ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করতেন স্থপতি ইমতিয়াজ। গত ৭ মার্চ বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরত আসেননি। পর দিন তাঁর স্ত্রী ফাহমিদা আক্তার কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই দিন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের চিত্রকোট কামারকান্দা সেতু এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ৯ মার্চ পুলিশ মরদেহ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে। এরপর বেওয়ারিশ হিসেবে মুন্সীগঞ্জ পৌর এলাকার কবরস্থানে ওই মরদেহ দাফন করা হয়। ১৮ মার্চ স্বজনরা নিশ্চিত হন বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশটি ইমতিয়াজের। এরপর কবর থেকে মরদেহ তোলার পর তা স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিশেষ অ্যাপসের সূত্র ধরে আলিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় ইমতিয়াজের। তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তিন দফায় ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কলাবাগানের ক্রিসেন্ট রোডের ৭৯/৩ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে ডেকে নেওয়া হয় স্থপতিকে। একটি রুমে ‘একান্তভাবে সময় কাটান আলিফ ও ইমতিয়াজ। কিছু সময় পর ওই রুমে ঢোকে আলিফের সহযোগী আরাফাত, মেঘ, মুন্না ও আনোয়ার। এক পর্যায়ে স্থপতির কাছ থেকে অর্থ দাবি করে চক্রের সদস্যরা। তবে ইমতিয়াজ তাদের জানান, তাঁর কাছে মাত্র ৩০০ টাকা রয়েছে। এরপরই তাঁর বুক, পিঠ ও মুখে মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ইমতিয়াজ। কলাবাগানের ফ্ল্যাটটি কয়েক মাস আগে আরাফাত ভাড়া নিয়েছিল। আরাফাতের বাসার গৃহকর্মীর স্বামী আনোয়ার। টাকার বিনিময়ে আনোয়ারকে এই গ্রুপে যুক্ত করা হয়েছিল। আরাফাতের ফ্ল্যাটটি সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের যারা নানা অপরাধে জড়িত তাদের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, ইমতিয়াজের নিথর দেহ গুম করতে তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক মেঘের প্রাইভেটকার মগবাজারে তাঁর বাসা থেকে কলাবাগানে নেওয়া হয়। সবাই ধরাধরি করে লাশ বাসা থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে নামিয়ে প্রাইভেটকারে তোলে। পেছনের সিটে এমনভাবে ইমতিয়াজকে বসানো হয়েছিল দেখে যাতে কারও সন্দেহ না হয়। ইমতিয়াজকে মাঝখানে বসিয়ে রেখে তাঁর দু’হাত মুন্না ও আলিফের কাঁধের ওপর রাখা হয়। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে প্রাইভেটকার মুন্সীগঞ্জ যায়। এরপর রাত ৯টার দিকে জঙ্গলের মধ্যে লাশ ফেলে তারা আবার ঢাকায় ফেরত আসে। আলিফকে বাসাবো, আনোয়ারকে গ্রিন রোড নামিয়ে দিয়ে আরাফাত, মেঘ ও মুন্না প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পরে চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যায়। ভারতে বন্দনা হিজড়ার আস্তানায় তারা ছিল।
ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) গোলাম সবুর বলেন, ভারতে আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে অভিযান চালায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে আসামিরা ওই স্থান থেকে পালিয়ে একইভাবে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসে। এরপর ডিবি পুলিশের অভিযানে ইমতিয়াজ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৩ মার্চ আরাফাত ও মুন্না এবং ১৫ মার্চ মেঘ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আসলে তারা দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিল। একই সঙ্গে ইমতিয়াজের মোবাইল ফোনটি হাতিরঝিলে লেকে ফেলে দেয় তারা।
আরো পড়ুন : হার্টের রিং দিয়ে পকেট কাটছে চিকিৎসকরা