সুনসান নীরবতা। চৈত্রের দুপুরে গাছগুলো নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় যানবাহন নেই। নেই পথচারী। শহর থেকে বেশ দূরে। লক্ষ্মীপুর গ্রাম। সবকিছুই ঠিকঠাক থাকলেও মানুষের সরব উপস্থিতি নেই। অজানা আতঙ্ক। ভয়ে গ্রাম ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ। কারণ ওই গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে ডাকাতেরা।
নিজের বাড়িতে বসবাস করতে হলে ডাকাতদের কথামতো উঠতে হবে, বসতে হবে। সময়-অসময়ে চাঁদা দিতে হবে। ছোট্ট একটি মাটির ক্লাব ঘরে রীতিমতো আদালত বসিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ওই গ্রামের বিচারক শাহিন- তৌহিদুল। তাদের প্যানেল বিচারক আরও ১৪ জন সক্রিয়। আলোচিত সেই লক্ষ্মীপুর গ্রাম বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নে।
সাংবাদিক পরিচয়ে ওই গ্রামে ঢুকতে বেশ সাহসের প্রয়োজন হয়। জীবনকে হাতের তালুতে নিয়ে ঢুকতে হয়। নিরাপত্তার বালাই নেই। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। একা ঢোকা বিপদ। সঙ্গত কারণেই সহকর্মী আতিকুর রহমান সোহাগ এবং এমদাদুল হককে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীপুর সরজমিন। নশরৎপুর রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে একটি সরু সড়ক লক্ষ্মীপুর গ্রামে প্রবেশ করেছে। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি মাটির ঘর চোখে পড়ে। স্থানীয় এক যুবক ঘরটি দেখিয়ে বলেন- এটিই হচ্ছে শাহিন- তৌহিদুলের আদালত। গ্রামের মানুষদের অন্যায়ভাবে তুলে এনে এই ঘরে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
সর্বশেষ গত ২২শে মার্চ বুধবার রাতে তথাকথিত ওই আদালত ঘরে একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের ছেলে আমিনুর ইসলামকে (৪০) তুলে এনে কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালায় শাহিন-তৌহিদুল বাহিনী। স্থানীয়দের বর্ণনায় ওই ঘরে বাহিনীর প্রায় ৩৭ জন কর্মী উপস্থিত ছিল। তারা পর্যায়ক্রমে সবাই নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে আমিনুরকে।
নিহতের স্ত্রী রোখসানা বেগম ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় বুক ভিজিয়ে ফেলেন। কোলে সাড়ে তিন বছরের ছেলে ওমর ফারুক সৌরভ। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলেন, শাহিন- তৌহিদুলের উপস্থিতিতে তাদের বাহিনীর লোকজন আমার স্বামীকে অমানবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। হাত-পাসহ শরীরের প্রত্যেকটি হাড় লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। পরে ধারালো কিছুদিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার শরীরের মাংস ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। রাতে যখন আমি জানতে পারি আমার স্বামীকে ক্লাব ঘরে মেরে ফেলা হয়েছে, তখনি আমি দৌড়ে সেখানে যাই। আমার স্বামীকে যেখানে মেরে ফেলে রেখেছে সেখানে যেতে চাইলে শাহিন-তৌহিদুল আমাকে যেতে দেয়নি। আমি তাদের পা জড়িয়ে ধরে স্বামীর কাছে যেতে চাইলে একটি ধারালো অস্ত্রের উল্টো পাশ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আমি তারপরও জোর করে আমার স্বামীর কাছে যাই। তার শরীরে হাত দিয়ে দেখি সব হাত ভাঙ্গা। দাঁত ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। আমি শরীরে হাত দেয়ার পর জোরে একটি নিঃশ্বাস নেয়। তারপর সেখানেই মৃত্যু হয়। আমি তারপরও শাহিন- তৌহিদুলের পা ধরে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলি স্বামীকে হাসপাতাল নেয়ার জন্য। কিন্তু তারা কোনো গাড়ি ঢুকতে দেয়নি। পরে একটি ভ্যানগাড়িতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে ডাক্তাররা বলেন আর বেঁচে নেই। আগেই মারা গেছেন।
এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে আমার জীবনের আলো একেবারে নিভে গেছে। রোকসানা বলেন, আমার স্বামী শাহিন-তৌহিদুলদের অন্যায় কার্যকলাপে মাঝে-মধ্যেই বাধা দিতেন। এটিই তার অপরাধ। আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে কীভাবে চলবো। খুনের পর অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিলেও বিভিন্ন মাধ্যমে তাকেও প্রাণ নাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। শাহিন-তৌহিদুলের স্ত্রীরাও ভয়ঙ্কর। তারা নিজ বাড়িতে অবস্থান করে রোখসানাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। তারা বলে বেড়াচ্ছেন কেবল একটা খুন হয়েছে। আরও তিনটা খুন করে এই খুনের ধামাচাপা দেয়া হবে টাকার বিনিময়ে। রোখসানা তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সাহায্য কামনা করেছেন।
খুনের শিকার আমিনুরের বড় বোন আফরোজা বেগম বাদী হয়ে তহিদুল-শাহীন সহ ৩৭ জন ও অজ্ঞাতদের আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মামলার পর ওই গ্রামের আইয়ুবের ছেলে ইসলাম ও আবু বক্কর এবং আফজালের ছেলে ওয়াহেদকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। কিন্তু ঘটনার ১২দিন অতিবাহিত হলেও হত্যা মামলার মূল আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। বর্তমানে হত্যা মূল আসামিসহ অন্যান্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে রয়েছে। মামলার বাদী আফরোজা বেগম বলেন, এখন পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। তাদের সহযোগিতা পাচ্ছি না। এতোদিন হয়ে গেলে পুলিশ একদিনও খোঁজ নিতে আসেনি।
আমিনুরের পিতা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হোসেন জানান, আমি ছেলের খুনিদের ফাঁসি দেখে মারা যেতে চাই। প্রকাশ্যে এভাবে আর যেন কোনো পিতার বুক খালি না হয় সেজন্য খুনিদের বিচার চাই। আমিনুর খুনের ঘটনার পর গ্রাম ছাড়া লোকজন তাদের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে শাহিন- তৌহিদুল ডাকাতদের বিরুদ্ধে সাহস করে মুখ খুলতে শুরু করেছে। গ্রামের নিরীহ মানুষরা অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেয়ালে এখন পিঠ ঠেকেছে। ডাকাতদের গা-ঢাকা দেয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে গ্রামে।
নির্যাতনের শিকার ওই গ্রামের ওয়াজকুরুনি, আব্দুল কুদ্দুস, তাজুল ইসলাম, মিরানা বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, শাহিন- তৌহিদুল শেখ রাসেল ক্লাবের নামে সারা বছর সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্যায়-অত্যাচার করে আসছে। নানা অযুহাতে সাধারণ মানুষের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা নিতো। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে অথবা চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে ওই ক্লাব ঘরে ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালায়। তাদের একটাই স্লোগান- ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’। শাহিন-তৌহিদুলদের ভয়ে গ্রামের প্রায় ৫০ পরিবার দীর্ঘদিন ঘর ছাড়া। তারা শহরের গিয়ে বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন। গ্রামের এসব মানুষ আরও জানান, আদমদীঘি থানার সাবেক একজন ওসি শাহিন-তৌহিদুলদের সেল্টার দিতো। পুলিশ সব সময় তাদের কথায় মানুষকে হয়রানি করতো। সেই ওসি বদলি হওয়ার পর পুলিশি হয়রানি কমলেও কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না পুলিশের। উপরের নির্দেশে নাকি ওই ডাকাতদের বিরুদ্ধে পুলিশ অ্যাকশন নিতে পারে না।
এ ব্যাপারে আদমদীঘি থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম রেজা জানান, হত্যার মামলার ৩ জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।
সুত্র-মানবজমিন
আরো পড়ুন : আরও এক মাইল ফলকের দ্বারপ্রান্তে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, আজ চলবে পরীক্ষামূলক ট্রেন