বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ড। আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন, আশা ও শেষ সম্বল। ক্ষতিগ্রস্ত সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। ঋণ শোধ করবেন কীভাবে? বঙ্গবাজার ও আশপাশের ১০টি মার্কেটে প্রায় ৫ হাজার দোকান পুড়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকা। এমন দাবি করে প্রাথমিকভাবে সাতশ’ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। ব্যবসায়ীরা জানান, বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, এনেক্সকো মার্কেট, ইসলামিয়া মার্কেট, বরিশাল প্লাজা ও মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেট, হোমিও প্লাজা, গোল্ডেন প্লাজা, বঙ্গ ইসলামিয়া, সিটি প্লাজা আগুনে পুড়ে গেছে। সেখানে শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, সালোয়ার কামিজসহ সব ধরনের পোশাক বিক্রি হতো। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দোকানিরা লাখ থেকে কোটি টাকার মালামাল তুলেছেন। আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে, কিছুই নেই। তবে বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের কাছ থেকে এখনো ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি।
এদিকে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অন্তত ২০ জন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, ঈদকে সামনে রেখে তারা দোকানগুলোতে ১ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। ছোট দোকানিরা ১০ থকে ২৫ লাখ টাকার মাল মজুত করেন। এদের কেউ কেউ ঋণ করে মাল তুলেছেন। সব মামলামালই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পোশাক ব্যবসায়ীদের হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা যায়।
বঙ্গবাজার মহানগর মার্কেটের দোকানি মো. ইব্রাহিম বলেন, মাত্র ২ বছর আগে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে দোকান শুরু করি। ঈদে ৮ লাখ টাকার মাল তুলেছি। বেচাবিক্রিও তেমন করতে পারিনি। কিন্তু সকালে আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খবর পেয়ে এসে দেখি কিছুই নেই। এখন পরিবার নিয়ে কীভাবে চলবো ভেবে পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে আমার প্রায় ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এনেক্সকো টাওয়ারের ইভা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার দোকানে সব ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি থ্রিপিস,অনপিস ও লেহেঙ্গা ছিল। সবগুলোই দামি মাল। একেকটার দাম প্রায় ২ হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত। প্রায় ২ কোটি টাকার বিদেশি কাপড় ছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। শবে বরাতের পরে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার নতুন কাপড় এনেছি। আমি এখন নিঃস্ব। আমার কিছুই অবশিষ্ট রইলো না।
বঙ্গবাজার মার্কেটের রুমি সুমি গার্মেন্টসের মালিক মো. ফারুক আহম্মেদ, আমার দোকানে সব জ্যাকেট ছিল। বিদেশি জ্যাকেট। এক এক টার দাম ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। সব মিলে প্রায় দেড় কোটি টাকার মাল ছিল। সাড়ে ৬টায় খবর পেয়ে রায়েরবাগ থেকে ছুটে এসেছি। এসে দেখি বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে আগুন এনেক্সকো পর্যন্ত চলে এসেছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
এনেক্সকো টাওয়ারের ৬ তলার নিউ রাকিব এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রিয়াজ হোসেন বলেন, আমি কিছু মালামাল উদ্ধার করতে পেরেছি। আমার দোকানে জিন্স প্যান্ট, চাদর, কম্বল, মশারি ছিল। সবমিলে প্রায় আড়াই কোটি টাকার মাল ছিল। দেড় কোটি টাকার মাল পুড়ে গেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ উদ্ধার করা গেছে। বাকি সব পুড়ে গেছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় আর উদ্ধার করা যায়নি। না হলে আমার এত ক্ষতি হতো না। যা উদ্ধার করেছি তাও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি পথে বসে গেছি। বাঁচবো কীভাবে আল্লাহ জানে।
এনেক্সকো টাওয়ারের নিচতলায় রাফি গার্মেন্টস ও মুভমেন্ট ফ্যাশনের মালিক আনোয়ার হোসেনের মা মমতাজ বেগম, আমার ছেলের দুটো দোকান ছিল। ৫০ লাখ টাকার প্যান্ট গেঞ্জি আছিলো। কিছু বের করতে পারিনি। এটা আছিলো পাইকারি গেঞ্জি প্যান্টের দোকান। সকাল ৮টার সময় খবর পেয়েছি। পরিবারের সবাই মিলে এসেও কিছুই বের করতে পারেনি। পোলাডা গতকালও ৬ লাখ টাকার মাল এনেছে। সব সুদের টাকা। খালি রোজার মাস বেচার লাইগা এই মাল আনছে। সব পুড়ে গেল। এখন টাকা দিবো কীভাবে বুঝবার পারছি না। আমার পোলাডা এবার শেষ হয়ে যাবে। সব তো গেলই অহন ঋণের টাকা পরিশোধ করমু কীভাবে? আমগো পরিবারের কারও হুশ নাই।
মহানগর মার্কেটের দোকানি মো. ফরিদ আহম্মেদ বলেন, ফায়ার সার্ভিস ইচ্ছা করলে এনেক্সকো ও ইসলামিয়া মার্কেট বাঁচাতে পারতো। কিন্তু তারা এসে দাঁড়ায় আছিলো। পানি মারেনি। আমরা বহুবার বলেছি ভেতরে ঢুকেন, পানি মারেন। কিন্তু তারা বলে উপরের আদেশ ছাড়া ভেতরে ঢোকা যাবে না। সব দোষ ফায়ার সার্ভিসের। তারা চালু থাকলে এতোগুলো মার্কেট পুড়তো না।
এনেক্স টাওয়ারের পাঁচতলায় গোডাউন থেকে মালামাল নামাতে যান বাংলার তাঁত দোকানের মালিক মো. মিজান ও তার বড়ভাই আবুল কালাম। গোডাউনের তালা খুললেও মালামাল সরাতে পারেননি তারা। আবুল কালাম বলেন, আমার ছোটভাই গোডাউনের তালা খুলছে। গোডাউন থেকে শুধু কালো ধোঁয়া বের হচ্ছিলো। আমরা ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই মাল নামানোর চেষ্টা না করেই চলে আসি। গোডাউনে আমাদের ১ কোটি টাকার মাল পুড়েছে।
বঙ্গ মহানগর মার্কেট কবির গার্মেন্টসের মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, আগুন প্রথমে আমাদের মার্কেটেই লাগে। ওখান থেকে সবগুলোতে ছড়িয়ে যায়। তাই আমার দোকান সকালেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো মাল বের করতে পারিনি। প্রায় ২ কোটি টাকার রেডিমেড জিন্স প্যান্ট ছিল। সকাল ৬-১০ আগুনের খবর শুনতে পারছি। এসে দেখি কিছুই নেই। শুধু পোড়া টিন পড়ে আছে।
বরিশাল প্লাজা মার্কেটের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, আমার সব শেষ। ২ কোটি টাকার উপরে মাল ছিল। দুই ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ১ কোটি টাকার উপর ঋণ আছে। ঈদ উপলক্ষে মাল আনছি। আবার শীতের শাল দেড় মাস হলো গোডাউন করছিলাম। কিছু নাই সব শেষ। সব শেষ হয়ে গেছে।
আরো পড়ুন : বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের উপর বিক্ষুব্ধ জনতা, সদর দপ্তরে হামলা