শাহিন-তৌহিদুল। লক্ষ্মীপুর গ্রাম তাদের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই চলে। রেজিস্ট্রেশনহীন শেখ রাসেল ক্লাবের নামে পুরো গ্রামের সাধারণ মানুষকে নানাভাবে জিম্মি করে রেখেছে তারা। নিজেদের বাড়িতে থাকতে হলেও ওই বাহিনীকে চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়। গাছের ফল ইচ্ছে হলেই পেড়ে নিয়ে যায়। ছাগল, মুরগি, হাঁস যখন যেটা মন চাইবে শাহিন-তৌহিদুল তাদের বাহিনী অথবা নিজেরাই যে কারও বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। বাধা দিলেই নির্যাতন। তাদের একটি স্লোগান এলাকায় চাউর আছে। ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’। কথায় কথায় মানুষকে মারধর।
এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। আদমদীঘি থানার সাবেক একজন ওসি শাহিন-তৌহিদুলদের মাথায় তুলেছে। যখনি গ্রামবাসী এক জায়গায় হয়ে শাহিন-তৌহিদুলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখন থানার ওসি পুলিশ পাঠিয়ে উল্টো সাধারণ মানুষকে শাসিয়েছেন। পুলিশের এই বৈরী ভূমিকার কথা নির্যাতনের শিকার সব মানুষই অকপটে বলেছেন। পুলিশ দিয়ে হয়রানির করার পর গ্রামের মানুষ যখন আর পেরে উঠতে পারেনি তখন অনেকটা আত্মসমর্পণ করে ডাকাতদের কাছে। আবার কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে আছে। পথ চলতে হলেও চাঁদা দিয়ে চলতে হতো। গ্রামের প্রবেশদ্বারেই শাহিন-তৌহিদুলদের বাড়ি। তাদের বাড়ির উপর দিয়েই গ্রামে প্রবেশ অথবা বাহির হতে হয়। সেই পথে চলতে হয় ভয় নিয়েই।
আরো পড়ুন : খুনের মামলা থেকে বাঁচতে সাধারন মানুষের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা শাহিন তৌহিদুলের
শাহিন-তৌহিদুলদের মূল কাজ চাঁদাবাজি: লক্ষ্মীপুর গ্রামের ওয়াজকুরুনি। তিনি শাহিন-তৌহিদুলদের বেড়ে ওঠার গল্প বলেন । তিনি বলেন, শাহিনের বাড়ির দেড় শতাংশ জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। এক সময় শাহিন নশরৎপুর বাজারে একটি দোকানে লেবার হিসেবে কাজ শুরু করে। পরে ওই দোকানের ম্যানেজার হয়। এরপর দোকানের মালিক মারা গেলে কিছুদিন ব্যবসার কাগজপত্র নিয়ে শহরে যাতায়াত করে। এরপর সে পুলিশের কোনো একটা লাইন পেয়ে যায়। তার কিছুদিন পর সে দোকানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে এসে বলে আমি রাজনীতি করবো। পুলিশ-প্রশাসন আমি দেখে নেবো। তারপর থেকেই শুরু শহিনের উত্থান। এখন অনেক নেতা এবং পুলিশ তার হাতে।
আর তৌহিদুল এক সময় স্টুডিও ব্যবসায়ী ছিল। তারপর কিছুদিন কাপড়ের ব্যবসা করে। এক সময় সেও সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গ্রামে এসে সন্ত্রাসী কারবার শুরু করে। শাহিন-তৌহিদুল ২০১৬ সালে আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসালাম খান রাজুর হাত ধরে দলে যোগ দেয়। শহিন এখন নশরৎপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তৌহিদুল কোন পদে আছে সেটা জানা যায়নি।
আরো পড়ুন : শাহিন-তৌহিদুল বাহিনীর ভয়ে গ্রাম ছাড়া সবাই; মাটির ক্লাব ঘর আদালতে খুন করা হয় আমিনুরকে
শাহিন-তৌহিদুলদের চাঁদা আদায়ের ক্ষেত্র: শাহিন-তৌহিদুলদের একনিষ্ঠ কিছু সহযোগী আছে। তাদের কাজ পুরো গ্রামের উপর নজর রাখা। কার বাড়িতে কী হচ্ছে, কী ঘটছে সেসব খবরা-খবর সংগ্রহ করা। কোন বাড়িতে ভালো কিছু ঘটুক আর খারাপ কিছু ঘটুক প্রত্যেক ঘটনার জন্যই শাহিন-তৌহিদুলদের টাকা দিতে হবে। ঘরের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কথা কাটাকাটির মতো কোনো ঘটনা ঘটলে আর সেই খবর শাহিন-তৌহিদুলদের কানে গেলে ওই দম্পতির রক্ষা নেই। নিমিষের মধ্যে দু’জনকে ক্লাবঘরে তুলবে। তারপর বিচার শুরু। বিচার মনেই গায়ে হাত তোলা। অমানবিক নির্যাতন করা। এই নির্যাতনকেই তারা বিচার বলে থাকে। পরে দশ বিশ হাজার টাকা জরিমানা আদায় সাপেক্ষে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
গ্রামের মকবুল হোসেনের স্ত্রী রেজিয়া বেগম তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমার ছেলে তার বউকে তালাক দিয়েছে। মেয়ের শারীরিক সমস্যা। বিয়েতে দেনমোহর ধার্য ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। মেয়ে আমাদের আত্মিয়ের মধ্যে। আমরা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মেয়ের হাতে দিয়ে দিবো। এমন সময় শাহিন-তৌহিদুল খবর পেয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা জোরপূর্বক আদায় করে। রেজিয়া বেগম বলেন, আমরা বাজারে ডিম সেদ্ধ করে বিক্রি করে সংসার চালাই। একবারে এত টাকা চলে যাওয়ায় আমার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।
একই গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী লাইলি বেগম বলেন, কিছুদিন আগে আমার স্বামীকে শাহিন বাহিনীর লোকজন পিটিয়েছে। তারপর আমার পালিত ১৫টি রাজহাঁস ধরে নিয়ে গেছে। কোনো কথা বলতে পারি না ওদের সঙ্গে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। আমরা গরিব মানুষ। রমজানে হাঁসগুলো বিক্রি করে ঈদ করতাম। সেটা আর হয়নি। কার কাছে বিচার দিবো? কে বিচার করবে?
গ্রামের যে কারও জমাজমি বিক্রি অথবা ভাগ বাটোয়ারা হলেও শাহিন বাহিনী হাজির হয়ে যায়। বিক্রি করলেও টাকা দিতে হবে আর ভাইয়ে ভাইয়ে নিজেদের জমি ভাগ বাটোয়ারা করে নিলেও চাঁদা দিতে হবে। তাদের কথায় উঠাবসা না করলেও জরিমানা দিতে হবে। বিয়ে-সাদি, আকিকাসহ যেকোনো আয়োজন করলেও তাদের পারমিশন নিতে হয়, দিতে হয় চাঁদা।
ওয়াজকুরুনি বলেন, আমার এলাকায় আমি সেচ ব্যবসা করি। আমার একটি ডিপ মেশিন আছে। সেটি দিয়ে এলাকার ইরি আবাদে সেচ দেই। শাহিন বাহিনী এবার আমাকে সেচের টাকা তুলতে দেয়নি। আমি বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছি না। যেকোনো সময় লাইন বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এতে এলাকার চাষাবাদের ক্ষতি হবে। সহজ কথায় শাহিন-তৌহিদুল বাহিনীর ইচ্ছাতেই পুরোগ্রাম চলছে। সম্প্রতি গ্রামের আমিনুরকে তাদের আদালতে হাজির করে পিটিয়ে হত্যার পর ওই বাহিনী গ্রাম ছাড়া।
বাহিনীর অন্যতম সদস্যরা: ইসলাম কবিরাজ, মহসিন আলী, আরিফ, আব্দুর রহমান বাবু, সাগর, আব্দুস সালাম, নজরুল ইসলাম, ফজলু, বকুল, মামুন, সাগর, জুয়েল, সোহেল, ইমরান হোসেন, মোকছেদ, হাসান, মতিউর রহমান, ফেরদৌস, মুরাদ, আলমগীর, ফরিদুল ইসলাম, মেহেদী, আব্দুল মজিদ, দোস মোহাম্মদ, সাইদুল ইসলাম, মোহন, শিমুল, মামুন, নুর ইসলাম, আব্দুর রহিম, রিয়াদ, নিলয়, আব্দুল আলিম। এরা সবাই শাহিন-তৌহিদুল বাহিনীর হয়ে কাজ করে বলে এলাকার সাধারণ মানুষ দাবি করেছেন।
সুত্র-মানবজমিন
আরো পড়ুন : মেলানিয়া ও ইভানকা ট্রাম্পের অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ট্রাম্প