শ্রীরাধা দত্ত : দক্ষিণ এশিয়ায় যাকে একসময় দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে সেই প্রাচীর জয় করেছে। গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তা ভারতীয় উপমহাদেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এবং ঐতিহাসিক আন্তঃসীমান্ত সংযোগগুলোকে পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি, এতদিন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগহীনতা এবং সামগ্রিকভাবে খারাপ পারফরম্যান্সের যে অভিযোগ ছিল তাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, বাংলাদেশ ও ভারত এখন আঞ্চলিক সংযোগের অগ্রদূত হতে প্রস্তুত। একইসঙ্গে এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যেকার সম্পর্ক এখন এই গোটা অঞ্চলের বিকাশের সম্ভাবনাকেও প্রতিফলিত করছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আছে ৪ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি স্থল সীমানা। দীর্ঘ সীমানা আছে সমুদ্রেও। ফলে প্রতিবেশী হিসেবে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একদিকে যেমন অনেক মিল রয়েছে, তেমনি দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বেরও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি বড় একটি সমস্যার সমাধান করেছিল। তবে নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি ফর্মুলা তৈরিতে ব্যর্থতা এবং তিস্তা চুক্তি না হওয়া দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর বছরের পর বছর ধরে ছায়া ফেলছে।
যদিও গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু পানি চুক্তি নিয়ে এমন আচরণের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভারতকে নিয়ে নেতিবাচক অনেক ধারণারও জন্ম হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি: সীমান্ত দিয়ে মানুষ ও প্রাণীর অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র পাচারসহ বেশ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত সমস্যা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে চলেছে। এক সময় বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিল ভারতবিরোধী একটি পক্ষ, যা নয়া দিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। যদিও সে সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী এমন অভিযোগ বার বার অস্বীকার করেছেন। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় শেখ হাসিনার আগমন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এর আগে থেকেই বাংলাদেশ নিজেকে তার অতীত থেকে আলাদা করতে শুরু করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জোট সরকার ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলোকে চিহ্নিত করে এবং এ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরমধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় বিদ্রোহীদের শিবির ধ্বংস করা এবং ভারতের কাছে এসব বিদ্রোহীদের হস্তান্তর করা। পরবর্তীকালে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক। ভারত বাংলাদেশকে প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে এবং তারা একসাথে একটি উচ্চাভিলাষী অংশীদারিত্ব উন্মোচন করেছে।
বর্তমানে ভারতের বহু বৈদেশিক নীতিতে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুই দেশের এই সম্পর্ক ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির প্রতিনিধিত্ব করছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে নিয়ে দেশটির ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ সফল হচ্ছে বাংলাদেশের সমর্থনের কারণেই। এ ছাড়া বাংলাদেশের কারণে বিমসটেক ফোরাম এবং ‘ইন্ডিয়ান ওশান রিম এসোসিয়েশনের’ জন্য ভারতের ফোকাস নতুন গতি পেয়েছে।
নানাবিধ পরিবহন ব্যবস্থা, যৌথ এনার্জি পাইপলাইন, ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে আন্তঃসীমা কানেক্টিভিটি সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অপ্রত্যাশিত পর্যায়ে চলে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রচ- উদ্বেগের মধ্যেও এই সম্পর্ক বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে অনেকেই ‘সোনালী অধ্যায়’ বলেও বর্ণনা করেন। প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালেও দুই দেশের মধ্যে যে সখ্য ছিল, বর্তমান অবস্থা সেটিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের বয়স এখন ৫১ বছর। যদিও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এর আগে থেকেই ছিল। পাকিস্তানের অধীনে থাকার সময় বাংলাদেশিরা যে দমন-পীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, তা থেকে রক্ষা পেতে ভারতের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান । দুই দেশের যৌথ বাহিনী ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এই অসাধারণ বন্ধুত্ব হোঁচট খেয়েছিল। এই ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়নি, বরঞ্চ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এর মধ্য দিয়ে বদলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের জন্মের প্রধান স্থপতি হিসেবে দলটি পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং ভারত উভয়েই নিজেদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে। তবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চলা সামরিক শাসনের সময় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা:
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটলো তখন রাজনীতিতে তিনজন ব্যক্তি এবং চারটি রাজনৈতিক দলের আধিপত্য ছিল। তারা হচ্ছেন, আওয়ামী লীগের নেত্রী ও শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেত্রী ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির স্থপতি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ ছাড়াও ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও বেশ প্রভাবশালী ছিল সে সময়।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিজের অবস্থানকে আরও সুসংহত করে, যেখানে বিএনপি এখন পতনের মুখে। ভারত সবসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছে। কারণ বিএনপি অতীতে ধারাবাহিকভাবে ভারতের বিরোধিতা করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার শেষ মেয়াদকালে দুই দেশের মধ্যেকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। ফলে নয়াদিল্লিতে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়নি।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির বেশির ভাগই সম্ভব হয়েছিল উভয়পক্ষের নেতারা ঘনিষ্ঠভাবে সেই সম্পর্ক লালন করেছিলেন। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ জোট সরকার ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের দুটি সংসদীয় নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। যদিও এই সরকারের বৈধতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাদের মতে আওয়ামী লীগ জোট সরকার মিডিয়া এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের পাশাপাশি দুর্নীতি ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। যার জেরে বাংলাদেশ একটি হাইব্রিড গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্রমবর্ধমানভাবে স্বৈরাচারী বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করছেন। তার ভারতের সঙ্গে নৈকট্য এবং তার প্রতি নয়াদিল্লির অভূতপূর্ব সমর্থন বিরোধীদের নজর এড়ায়নি। বর্তমানে বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে বাস্তবিকভাবে চ্যালেঞ্জ নেয়ার জন্য খুব দুর্বল একটি দল। তবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দলটির কিছু আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে টিকে থাকা দরকার। এ বছর আরেকটি একতরফা নির্বাচনের বৈধতা আদায় খুব কঠিন হবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সময়কালের পর ভারত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
বর্তমানে, দুই প্রতিবেশী দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক চমৎকার কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল ভিত্তি অর্থাৎ দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক দুর্বল। উভয়পক্ষের নতুন প্রজন্মই আর আবেগের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত নেই। তাছাড়া ধর্মীয় মেরুত্বের কারণে দুই দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যকার বন্ধুত্ব আর ‘ফর গ্রান্টেড’ থাকছে না।
এমন অবস্থায় সবথেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কি এরইমধ্যে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে যে এই অবস্থার আর কোনো পরিবর্তন ঘটবে না? বাংলাদেশে চীন ক্রমশ ভারতকে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করছে এবং পাকিস্তানও এখন বাংলাদেশকে বন্ধু হিসেবে পেতে চায়। এমন অবস্থায় শুধু একটি নির্দিষ্ট অংশের বাংলাদেশিদের কাছে বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হওয়া ভারতের জন্য যথেষ্ট নয়। এই অঞ্চলের ক্রমশ পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র একজন শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করে ভারত বাংলাদেশে তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারবে না।
(লেখক: প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বর্তমানে ও.পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের একজন নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। এর আগে তিনি নেইবারহুড স্টাডিজ বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সেন্টারটির প্রধান ছিলেন। এ ছাড়া কলকাতায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউটে এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড এনালাইসিসের ফেলোশিপ অর্জন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতের প্রতিবেশী, আঞ্চলিকতা, আন্তঃসীমান্ত বিষয়ক ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষণায় আগ্রহী তিনি। তার সম্পাদিত সর্বশেষ বাংলাদেশ বিষয়ক ভলিউম ‘নিউ জার্নি মুভিং বিয়োন্ড রিজিওনাল আইডেনটিটি’ প্রকাশ হবে শিগগিরই। সেন্টার ফর রিসার্স অন স্ট্র্যাটেজিক অন সিকিউরিটি ইস্যু বিষয়ক অনলাইন ন্যাটস্ট্র্যাট-এ প্রকাশিত ‘ভারত-বাংলাদেশ: দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন দিগন্তের হাতছানি’ শীর্ষক তার লেখার অনুবাদ)