সিরাজ উদ্দিন সাথী: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের জাতীয় বীরদের অন্যতম। নিবেদিতপ্রাণ, ব্যতিক্রমী চরিত্র। আমাদের কালের এক কৃতী ত্যাগী মানুষের মুখ। সাহসী স্পষ্টবাদী মানুষ। এমন মানুষ কয়জন আছে আমাদের মাঝে ?
১৯৭১ সাল। আমাদের জাতীয় জীবনে উত্তাল এক সময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যার পটভূমিতে দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারা নানাভাবে পক্ষত্যাগ করে এসে নিজ দেশের মুক্তির লড়াইয়ে শরিক হয়েছেন। জেনারেল ওসমানীকে প্রধান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার একটি সামরিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। দলে দলে ছাত্র যুবকেরা ভারতে গিয়ে ট্রেনিং আর অস্ত্রের জন্য ভিড় করছেন।
অনেকের ভিড়ে আমরাও গিয়েছি এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে। নরসিংদী থেকে লে চড়ে নবীনগর হয়ে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে আগরতলায়। আগরতলায় কংগ্রেসভবন এবং কলেজটিলা হয়ে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মতিনগরে। সেক্টর কমাণ্ডার খালেদ মোশারফ। মতিনগরে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যদের পাশাপাশি আমাদের মতো ট্রেনিং প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘স্টুডেন্টস কোম্পানি’। ছোট টিলায় তাবু টানিয়ে ক্যাম্প। ট্রেনিং দিচ্ছেন আমাদেরই সেনা কর্মকর্তারা। ক্যাপ্টেন হায়দার এর প্রাণপুরুষ।
অদূরেই দুই দেশের সীমান্ত। বিএসএফ টহল দেয় এ প্রান্তে। অপর প্রান্তে পাকিস্তানিদের চৌকি অনেকটা দূরে। সীমান্ত সুরক্ষার চেয়ে মহাসড়কে টহল দেয়াই তাদের প্রধান কাজ। তবে মতিনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের খবর তারা পেয়ে যায় খুব সহসাই। মে মাসের এক রাতে তারা দূর থেকে গোলাবর্ষণ করে ক্যাম্প লক্ষ্য করে। তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তাতে। কিন্তু খালেদ মোশারফসহ সকলেই চিন্তিত হলেন এর নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হলো ক্যাম্প স্থানান্তরের।
মতিনগর থেকে মেলাঘর। একদিন সারাবেলা ক্যাম্প স্থানান্তরের কাজ চললো। আমরা সবাই ব্যস্ত রইলাম সবকিছু ট্রাকে তুলে দিয়ে নতুন গন্তব্যে পাঠানোর জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর থেকে ছিনিয়ে আনা শক্তিশালী জলপাই রঙের ট্রাকে ভরে মালামাল যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতি ট্রাকে মালামালের উপর বসে যাচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধাগণ। আমরা কয়জন রয়ে গেলাম শেষ ট্টাকে যাওয়ার জন্য। অবশেষে সর্বশেষ ঐ ট্রাকে অবশিষ্ট মালামাল তোলার পর আমরা এর উপরে বসলাম। ফুরফুরে মেজাজ তখন আমাদের সকলের। ট্রাকটি জঙ্গলের ছোট রাস্তা থেকে বেরিয়ে বড় সড়কে এসে মেলাঘরমুখী চলতে লাগলো। উঁচু নিচু টিলা টেঙ্গরের বিপদসঙ্কুল সড়ক। আঁকাবাঁকা পথ। পড়ন্ত বিকেলের কোমল বাতাসের ছোঁয়ায় আমরা তখন গলা ছেড়ে গান ধরি- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
হঠাৎ দুর্ঘটনা। পাহাড়ী পথের এক বাঁকে। আমরা আহত হই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আমার আর সমর সেনের পরনের প্যান্ট ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যায়। মনে হয় শরীরের নিচের এই অংশ আর আমার শরীরে যুক্ত নেই। ভীষণ কান্না পায়। দেখতে পাই অন্যরাও কমবেশি আহত। তবে আমার আর সমরের অবস্থাই সঙ্কটাপন্ন। এক পলক দেখে আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে, দেখতে পাই কয়েক ডজন প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে আমরা। মেলাঘরের প্রধান সড়ক থেকে কয়েকজন নিজেদের হাতের উপর শুইয়ে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। যেখানে আমাদের নতুন ক্যাম্প হলো সে জায়গাটি সড়ক থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে। পাহাড়ী জঙ্গলাকীর্ণ টিলা। তখনো কোনো রাস্তা তৈরি হয়নি। সহযোদ্ধারা পালা করে কোলে নিয়ে ঐ জঙ্গলের টিলায় আমাদের নিয়ে গেলেন।
মেলাঘরের দুই তিনটি টিলাজুড়ে ২ নম্বর সেক্টরের নতুন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প। টিলার উপর বাঁশ বেত আর ছনের তৈরি ঘর। ঘরের ভিতর বাঁশের মাচা। টিলার একটিতে এমন ঘরে কমাণ্ডারদের অফিস ও থাকার ব্যবস্থা। ঐ টিলার ঢালুতে তিন-চারটি তাবু টানিয়ে স্থাপিত হলো মেডিক্যাল সেন্টার। এর দুইটিতে আহতদের স্থান হলো। ছোট্ট তাবু। এর মধ্যে মোটা কাপড়ের দুইটি করে টানা বিছানা। এর একটিতে নিয়ে আমাকে শোয়ানো হলো। তখন অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। চিৎকার করছি। যারা বয়ে আনলো, তারা প্রবোধ দিচ্ছেন। মাথায় বাতাস করছেন। এসময় একজন ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোক মাথা নুইয়ে তাবুতে ঢুকলেন। আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন- কেঁদো না। ঠিক হয়ে যাবে সব।
আমার সঙ্গীরা লোকটির সাথে আবেগে আপ্লুত হয়ে কথা বলছিল। বলছিল, এই জঙ্গলে কি করে তার চিকিৎসা হবে। সে তো মারা যাবে অঘোরে। দেখছেন না কিরকম চিৎকার করছে ! আগরতলা হাসপাতালে পাঠাতে হবে। ভদ্রলোক তাদের কথায় রাজি হলেন না। বললেন- এখানে আমাদের যা আছে তা দিয়েই চিকিৎসা করবো। তোমরা এখানে আছো, চোখের সামনে থাকবে, তার ভালো লাগবে। আগরতলায় কে তার পাশে থাকবে। একাকী আরো কষ্টে পড়বে।
ততক্ষণে আমার শরীরের ক্ষতবিক্ষত অংশে লেপটে থাকা রক্ত ধুইয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। সাদা ব্যাণ্ডেজে ঢেকে ফেলা হয়েছে আমার দুই পা। তারপর পায়ের গোড়ালিতে পাথর বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নড়াচড়া বন্ধ। চিৎ হয়ে তাবুর অনুচ্চ সামিয়ানার দিকে একটানা তাকিয়ে থাকার ব্যবস্থা।
সঙ্গীরা জানালেন, যিনি আমাকে প্রবোধ দিয়ে এখানে চিকিৎসা দেয়ার কথা বললেন তিনি বিলাত থেকে আসা ডাক্তার। তিনিই এই চিকিৎসা ক্যাম্প এখানে স্থাপন করেছেন। তাঁর নাম জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সঙ্গে তাঁর মাত্র কয়জন সহকর্মী। থাকেন পাশেই এক ছোট্ট তাবুতে। প্রানবন্ত মানুষ। যতবার দেখতে আসেন সেরে উঠার আশা স ার করেন। উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করেন। অনবরত তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন- আমি কী সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো ? ট্রেনিং নিতে পারবো কী ? যুদ্ধে যেতে পারবো কী? তিনি একটুও বিরক্ত হন না।
দেবদূতের হাসি দিয়ে বলেন- বিলকুল পারবে। একটুও ভেবো না তুমি। কিন্তু উদ্বেগে আমার বুক কাঁপে দুরু দুরু। তাবুর পাশ দিয়ে অতি সকালে লেফ্ট রাইট করতে করতে সঙ্গীরা সব দল বেঁধে যায়। আমি তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই, দেখতে পাইনা। ভীষণ কান্না পায় তখন। ভাবি- হায় ! যুদ্ধে যাওয়ার যে স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে দেশ ছেড়ে এখানে এসেছি তা বুঝি বৃথা হয়ে যায় !
সংবেদনশীল তরুন এই ডাক্তার আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন। তিনি ক্যাপ্টেন হায়দারকে বলেন- আমার সঙ্গীরা যেনো নিয়মিত আমাকে দেখতে আসেন ও কথা বলেন। স্টুডেন্টস কোম্পানির প্রথম ব্যাচের কোম্পানি কমাণ্ডার ঢাকা কলেজের ভিপি এম এ আজিজ। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নিয়ে এটি গঠিত। বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ছাত্ররা রয়েছেন এতে। তবে অধিকাংশই তদানীন্তন ঢাকা জেলার। ডাক্তার সাহেবের কথা অনুযায়ী তারা নিয়মিত এসে আমাকে ও অন্যদের মানসিক অবসাদ দূর করতে ভূমিকা রাখলেন।
অবশেষে একদিন ডাক্তার সাহেব বললেন- তোমাকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। ছেড়ে দিচ্ছি তোমার মনের অবস্থার কারণে। তুমি ক্যাম্পে গিয়ে অন্যদের সাথে ট্রেনিং নিতে পারবে। তবে পিটিতে দৌঁড়াবে না। লেফট রাইট করবে না। সাথে থাকবে। ক্লাসে যোগ দেবে। সাবধানে চলবে। আমি তাঁর আদেশ মেনেই ট্রেনিং নিই। পরে সুস্থ্য পায়ে অন্যদের মতোই তাদের সঙ্গে সকল যুদ্ধ মহড়ায় অংশ নিই। ট্রেনিং শেষে জুলাই মাসে দলবলে নিজেদের এলাকায় ফিরে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিই। কৃতজ্ঞ থাকি মেলাঘরের ঐ তাবু টানানো চিকিৎসালয়ের পরম সহানুভূতিশীল বিলাত ফেরত ডাক্তারের কাছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর আমি একবার সাভারের গাজীরচটে গিয়েছি এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ঢাকা-আড়িচা মহাসড়ক ছাড়া ঐ অ লে তখনো তেমন পাকা রাস্তা হয়নি। লাল মাটির কাঁচা রাস্তা। হালকা বসতির এলাকা। টেঙর ও বনবাদালিতে ভর্তি। শালবন আছে অনেক জায়গায়। নিবিড় পল্লীগ্রাম। এমন গ্রামে অবাক হয়ে দেখছি বিশেষ পোশাকে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। তারা স্বাস্থ্যকর্মী। অবাক হই একারণে যে তখনকার বাংলাদেশের সমাজে এমনটা ছিল অকল্পনীয়। রক্ষণশীল ঐ সমাজে মেয়েদের সাইকেল চালানোর কথা চিন্তা করা যায় না। জিজ্ঞেস করে জানলাম- এরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের। সবাই যার কথা বলছেন, তিনি আর কেউ নন, মেলাঘরের আমাদের ঐ ডাক্তার সাহেব। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্থানীয় লোকেরা তাকে শ্রদ্ধা করেন, মানেন। তিনি মানুষের ভালোর জন্য কাজ করছেন এমনটা বিশ্বাস করেন। তাই যে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে বাড়িঘরে যাচ্ছেন, তারা গ্রামের লোকের সুরক্ষা পাচ্ছেন। আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে গ্রামে জনপ্রিয় করে তুলছে সমন্বিতভাবে।
সেই যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিতে বিলাতের আয়েশী জীবন পায়ে দলে এসে মেলাঘরে ছোট্ট তাবু টানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুললেন সেই পথ পরিক্রমা থেকে আর ঐ চাকচিক্যের জীবনে তিনি ফিরে গেলেন না। তাবুর সেই চিকিৎসাকেন্দ্রকে তিনি পরে বেশ বড়সড় ফিল্ড হাসপাতাল বানালেন অন্য চিকিৎসকদের নিয়ে। এই হাসপাতাল ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সকলের স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থল। সেই পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র। রাজধানী কিংবা নিজের বাড়ি চট্টগ্রামে নয়, তখনকার পল্লীগ্রাম সাভারের এক গাঁয়ে। ‘চলো, চলো, গ্রামে চলো’ – এ কথা বলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে।
দেশে কিংবা বিদেশে তিনি হতে পারতেন বিলাসী চাকচিক্যময় জীবনের অধিকারী। হতে পারতেন প্রথিতযশা সরকারি সুবিধাভোগী চিকিৎসক অথবা ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিত্তশালী মালিক। হতে পারতেন মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদ। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। তিনি পরার্থপরতার নির্মোহ সংগ্রামী পথ বেছে নিয়েছেন। যাপন করছেন অতি সাধারণের সাদাসিদে জীবন। বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় এক অনুকরণীয় জীবন-চরিত্র তাঁর।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি ও ঔষধ নীতির জন্য তিনি বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। আমার জানামতে দুই সরকারের আমলে তিনি এক্ষেত্রে অবদান রাখার চেষ্টা করেন। আজকে যে আমাদের ঔষধ শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, এর অনেকটা কৃতীত্ব তাঁর প্রণীত ঔষধ নীতির।
নিজের প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য হাসপাতালকে তিনি পরিচালনা করছেন রোগীবান্ধব কেন্দ্র হিসেবে। কম খরচে স্বাস্থ্যসেবার এক অতুলনীয় নজির স্থাপন করে অন্যদের তিনি উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। কিডনি রোগীর ডায়ালেসিস হয় তাঁর কেন্দ্রে অনেক কম খরচে। জাতির জন্য তাঁর অবদানের জন্য তিনি দেশে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন। এশিয়ার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত র্যামন ম্যাগসাইসাই ও সুইডেনের রাইট লাভলিহুড পুরস্কার পেয়েছেন। আমেরিকার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে “ ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো ” পদকে ভুষিত করেছে।
এবার আমরা লক্ষ্য করেছি, চীন ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে করোনার সংক্রমণ ঘটার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশে এর বিপদ আঁচ করতে পেরে ভূমিকা নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সরকার, চিকিৎসক ও সাধারণ নাগরিককে নানাভাবে সতর্ক করার পাশাপাশি বিদেশ থেকে অনেক কষ্টে উপাদান সংগ্রহ করে করোনা সনাক্তকরণের কিট তৈরি করেছেন। র্যাপিড টেস্ট কিড। যা ছিল জাতির জন্য একান্ত প্রয়োজন। দেখলাম অল্পখরচে সনাক্ত করার এই কিট ব্যবহারের জন্য তিনি স্বাস্থ্য বিভাগে দেনদরবার করতে থাকলেন। অনেকদিন। অবাক হয়ে দেখলাম- সব জায়গা থেকে তিনি চরম বৈরিতার সম্মুখীন হলেন। টানা হেঁচরা চললো অনেকদিন ধরে। কিন্তু কেন তা বুঝা গেল না। অতঃপর টেস্ট কিট যেনো গভীর শীতল হিমাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে রইলো। একসময় তিনি ঐ কিট দিয়ে নিজের করোনা টেস্ট করে দেখলেন ঠিক ফলাফল দিয়েছে। তিনি যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ঐ কিটের টেস্টেই বুঝলেন। আর করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে রত থাকলেন । অনেকেই ভাবলেন- তাঁর স্বাস্থ্যের যে অবস্থা বাঁচবেন না। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলেন। সুস্থ্য হয়ে ওঠলেন।
অনেকটা সময় ক্ষেপন করে অবশেষে ১৭ জুন কর্তৃপক্ষ বললো- এই কিট উপযুক্ত নয়। হায় বিধি! তিনি অবশ্য বলছেন- এটা দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত। স্বাস্থ্য বিভাগের সিদ্ধান্তের বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ না করেও বলা যায়- গণস্বাস্থ্যের এই কিট নিয়ে শুরু থেকে তারা যে মনোভঙ্গি দেখালেন, উন্নাসিক আচরণ করলেন, তাতে আম জনতার কাছে মনে হয়েছে কেবল বৈজ্ঞানিক যুক্তি নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু আছে পর্দার অন্তরালে। এখানেই তো শেষ নয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে যে প্লাজমা সেন্টার তিনি খুললেন, সেটাও বন্ধের কথা বলা হলো। গণস্বাস্থ্যের যে মেধাবী বিজ্ঞানী টেস্ট কিট উদ্ভাবন করলেন সেই বিজন কুমার শীলের উপরও নিষেধাজ্ঞার খরগ নেমে এলো।
বাংলাদেশ এখনও করোনার খারাপ সময় কাটাচ্ছে। গত ছয় মাসে কেবল সংক্রমণই বৃদ্ধি পায়নি সামগ্রিক স্বাস্থ্য সেবার বিপর্যয় ঘটেছে। চিকিৎসা সেবা খাত ভেস্তে গেছে। করোনার টেস্ট করাতে গিয়ে মানুষের কী না দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে! কষ্ট ও অর্থ- দুইয়েরই ব্যবচ্ছেদ হয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহর সতর্ক বার্তার গুরুত্ব দিলে এবং তাঁর উদ্যোগসহ সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হলে এই বিপর্যয় ঠেকানো যেত। রোগীদের হয়রানির উপসম হতে পারতো। তাঁর পরামর্শগুলো গুরুত্ব দেয়া হলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হতো।
একাত্তুরের রণাঙ্গন থেকে ওঠে আসা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা, লড়াকু এই মানুষটি করোনায় অসুস্থ থাকাকালে আমার মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ দেশবাসী সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর পরিপূর্ণ সুস্থ্যতার জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করেছেন। এই সঙ্কটকালে তাঁর মতো ব্যক্তির প্রয়োজন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেছেন। মনে করেছেন-স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে তিনি আমাদের দিকপাল ও পথপ্রদর্শক হতে পারেন আরো বহুকাল।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি আমার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই ঋণ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ শোধ করতে পারিনি। আমরা চেয়েছি জাতির এই কঠিন সময়ে তিনি আমাদের বাতিঘর হিসেবে বিরাজ করুন।
আল্লাহর রহমতে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সেবার তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে আগের মতোই নির্ভীক কন্ঠে সোচ্চার থেকেছেন, যেমনটা তিনি আজীবন ছিলেন। কয়দিন আগে আবার অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। স্বজনেরা বিদেশে নিতে চাইলো চিকিৎসার জন্য। গেলেন না। আজ রাতে অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। চলে গেলেন সাহসী বীর, মুক্তিযোদ্ধা, জাতির বিবেক।
শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। স্যালুট জানাই সাহসী, নির্লোভ এই মানুষটিকে। পুরো জীবন যিনি উৎসর্গ করেছেন জাতীয় স্বার্থে ও গণমানুষের কল্যাণে। আমরা তোমায় ভুলবো না। জেগে থাকবেন নিজের কর্মের মাঝে উজ্জ্বল তারকার মতো।
সেই চিরায়ত কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই প্রসঙ্গত- যে জনসমাজে ত্যাগী, কৃতি ও মহৎপ্রাণ মানুষের কদর হয় না, সেই সমাজে জাকিয়ে বসে স্বার্থান্ধ, অযোগ্য ও ক্ষুদ্রপ্রাণের লোকেরা, জগদ্দল পাথরের মতো। আমরা তো তেমনটা চাইনি। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ থেকে যে চেতনার বিকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, যা তিনি স্বাস্থ্যসেবায় উড্ডীন রেখেছেন এতটা কাল, তা সমুন্নত থাকুক চিরকাল। বলাবাহুল্য সেই চেতনা থেকে আমরা সরে গেছি ক্রমাগত অনেকটা দূর।
– সিরাজ উদ্দিন সাথী
মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক