স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে : অপেক্ষা সিলেটে নয়। গোটা দেশে। বিদেশেও। কী সিদ্ধান্ত আসে। অবশেষে গতকাল সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। নির্বাচন করছেন না তিনি। সরে দাঁড়ালেন। তখন রেজিস্ট্রারি মাঠজুড়ে পিনপতন নীরবতা। হাজারো মানুষের উপস্থিতি। লম্বা বক্তৃতা দিলেন আরিফ, ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরলেন।
পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। ইভিএম প্রসঙ্গ টানলেন। পুলিশের ধরপাকড়ের বিষয়টিও উত্থাপন করলেন। এরপর জানিয়ে দিলেন নির্বাচন করছেন না। তার এই ঘোষণার পর রেজিস্ট্রারি মাঠে পিনপতন নীরবতা। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া দেখালেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সদস্য। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। এবার সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল আরিফের জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
বিএনপি থেকে আগেই সবাইকে সিটি নির্বাচন না করার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। ছাড় পাননি মেয়র আরিফও। লন্ডনে গিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন। ওখান থেকে মিললো রেড সিগন্যাল। বিএনপি’র সবাই একবাক্য্যে নির্বাচনে যেতে বারণ করলেন। ঢাকায় গিয়ে দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তার তরফ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। ২০ দিন নগরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকেই ইতিবাচক ছিলেন। বেশিরভাগই ভোটের দাঁড়ানোর পক্ষে না। সিলেটের আলেম-উলামা সমাজের সঙ্গে কথা বললেন। বরুনার পীর হযরত মাওলানা রশিদুর রহমান ফারুক ওমরা থেকে আসার পর দেখা করলেন।
সিলেটের মারা যাওয়া আলেম দরগাহের মুহতামিম হযরত মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি হুজুরের সঙ্গেও দেখা হলো। কেউ-ই ভোটে দাঁড়ানোর পক্ষে মত দিলেন না। সর্বশেষ নিজের বৃদ্ধা মায়ের মতামত নিলেন। মা-ও না করে দিলেন। এরপর সিদ্বান্ত নিতে আর দেরি করেননি আরিফুল হক চৌধুরী। শুক্রবারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। নির্বাচন করবেন না। তবে- শুক্রবার বিকালে প্রশাসনের ঘটনা তাকে মর্মাহত করেছে। রেজিস্ট্রারি মাঠে ঢুকতে না দেয়ায় বসে যান ফটকে। অবশেষে তিনি নাগরিক সভার অনুমতি পান। গতকাল বিকালে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে তিনি জানিয়ে দিলেন সিদ্ধান্ত। নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, কেন্দ্রীয় সহ-ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকসহ সিলেটের সিনিয়র নেতারা।
তবে বক্তৃতা করলেন কেবল মেয়র আরিফ একাই। এর আগে হযরত শাহজালাল (রহ.)’র মাজার জিয়ারত করেন আরিফ। পরে বিকাল ৩টায় মাজার প্রাঙ্গণ থেকে হেঁটে হেঁটে তিনি রেজিস্ট্রারি মাঠে পৌঁছেন। এ সময় তার সঙ্গে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ছিলেন। আসার সময় তিনি হাত উঁচিয়ে নগরবাসীকে অভিভাবাদন জানান। রেজিস্ট্রারি মাঠে দীর্ঘ বক্তৃতায় মেয়র আরিফ পরপর দুইবার তাকে নির্বাচিত করায় নগরবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বর্তমান পরিবেশ তুলে ধরে বলেন, প্রশাসনের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছেন। এজন্য্য তারা গত দু’সপ্তাহ ধরে তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন। অতীতে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিলেটের সম্প্রীতির কারণে সবাই মিলেমিশে নির্বাচন করেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। এবার বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে ধরপাকড় করা হয়েছে। অনেকের বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। যারাই তার পক্ষে রয়েছেন তাদেরকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে করে সিলেটে ভোটের পরিবেশ নেই। এই অবস্থায় তিনি নির্বাচন করলে দমন পীড়ন বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন আরিফ। নির্বাচন করলে মামলা, গ্রেপ্তার, তল্লাশি বাড়বে। ফলে তিনি তার দলের নেতাকর্মী এবং নগরবাসীকে এই হয়রানির মুখে ফেলতে চান না বলে জানান।
বক্তৃতায় বার বার ইভিএম নিয়ে শঙ্কা জানান আরিফ। বলেন, ইভিএম ভোট এখনো আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আপনি ভোট দেবেন এক জায়গায়, যাবে অন্য জায়গায়। এই ভোটে কোনো বিশ্বাস নেই। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কার কথাও জানান। মেয়র আরিফ জানান, তিনি বিএনপি’র একজন কর্মী। তিলে তিলে এই দলের ভেতরেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এই দলের শীর্ষ নেতারাও নির্বাচনের পক্ষে না। অতীতে কখনো দলের বিরুদ্ধে যাননি, ভবিষ্যতেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। এ কারণে সর্বাগ্রে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নির্বাচন না করার সিদ্বান্ত নেন। মেয়র আরিফ তার বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বিএনপি আমার রক্তে রন্ধ্র্রে অস্থি মজ্জায়। আমি আপনাদের আরিফ, বিএনপির আরিফ হয়ে অন্ধকারের গহীনে ফেলতে পারি না দেশবাসীকে।
স্পষ্টত এই নির্বাচন হবে প্রহসনের নির্বাচন। সুতরাং এই প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না, তাই আমার দলীয় এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।’ ‘আরিফ বলেন, যাদের পরামর্শ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি, আমার মাতৃতুল্য পরম শ্রদ্ধাভাজন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং আমার মা জননী ও আমার মুর্শিদ বারণ করেছেন এমন প্রহসনের নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে। আজ সিলেটের অলিতে গলিতে নানা প্রান্তে লাখো জনতা যারা আমি নির্বাচন করবো বলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন নির্বাচনে অংশ নেয়ার বারবার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন, সেইসব লাখো জনতার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাচ্ছি, কিন্তু এবার আপনারা সবাই আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।’
আরো পড়ুন : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কবর স্থান থেকে কঙ্কাল চুরির অভিযোগ