বরিশাল সিটির বর্ধিত এলাকায় সড়ক, পয়ঃনিষ্কাশন-পানির সুবিধা নেই; কিন্তু কর দিতে হচ্ছে ১৬ আনা

অনুসন্ধানী অর্থনীতি ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ জনপ্রতিনিধি প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি শিল্প প্রতিষ্ঠান হ্যালোআড্ডা

বিশেষ প্রতিবেদক, বরিশাল: প্রতিবেশীর গভীর নলকূপের পানিতে পরিবারের তৃষ্ণা মেটে বাদল খানের পরিবারের। গোসলসহ অন্যান্য দরকার মেটাতে ভরসা বাড়ির সামনের মজা পুকুরই। কোনো অজপাড়াগাঁ নয়; এ অবস্থায় জীবন কাটছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকার বাসিন্দাদের। সড়ক নেই, পয়ঃনিষ্কাশন-পানির সুবিধা নেই; কিন্তু কর দিতে হচ্ছে ১৬ আনাই। কাউন্সিলররাও বলছেন, উন্নয়ন হয়নি, অযথাই কর দিচ্ছেন বাসিন্দারা।

তেঁতুলতলার কলাডেমা এলাকাটি বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। শনিবার দুপুরে সেখানে কথা হয় বাদল খানের সঙ্গে, তাঁর ঘরের দুয়ারে। পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম। পল্লী বিদ্যুতে ৪১ বছর চাকরির পর তেঁতুলতলায় বাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন বাদল খান। বাড়ির পাশেই দুই একর জমি বর্গা চাষ করে জীবন চলছে তাঁর।

আর এক মাস বাদে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোট। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২১ বছরে বরিশালে চারজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, বিদায়ও নিয়েছেন। পঞ্চম মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহও বিদায়ের পথে। কিন্তু বাদল খানের মতো বর্ধিত এলাকার বাসিন্দাদের দুঃখ ঘোচেনি; বরং দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বছর দশেক আগে যেসব রাস্তা নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো ভেঙেচুরে একাকার। কাদামাটিতে লেপ্টে থাকা ইটের খোয়া আর কালো পিচ সাক্ষ্য দিচ্ছে, এখানে এককালে পাকা সড়ক ছিল।

এমনই সড়কের ধ্বংসাবশেষের পাশে বাদল খানের বাড়ি। ফাতেমা বেগম বললেন, কোনো নাগরিক সুবিধা পান না। সড়ক, ড্রেন তো নেই; নেই সড়কবাতিও। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পানির। অথচ মাসে ২০০ টাকা পানির বিল দিতে হয়। বাড়ির জন্য ২৫০ টাকা গৃহকর দিতে হয়।

নোনাপানির সমস্যা চলে এসেছে বরিশাল শহরে। ৮০০ থেকে হাজার ফুট গভীর বোরিং করা সাবমার্সিবল মেশিনে সুপেয় পানি পাওয়া যায়। এটা অনেক খরচের ব্যাপার। তাই গরিবের ভরসা প্রতিবেশীর নলকূপ। পানি সরবরাহ করতে না পারলেও ২০১৮ সালে সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হওয়ার পর প্রতিটি বাড়ি থেকে নেওয়া হচ্ছে বিল। বেড়েছে গৃহকরও। এমনও নজির রয়েছে, বার্ষিক ৩০০ টাকার গৃহকর বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

২০০২ সালে বরিশাল পৌরসভা উন্নীত হয় সিটি করপোরেশনে। বিলুপ্ত পৌর এলাকার ২৩টি ওয়ার্ডের সঙ্গে সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের আংশিক যুক্ত হয়। এ এলাকা করপোরেশনের ৭টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। এগুলো বর্ধিত এলাকা নামে পরিচিত। এখানকার অধিকাংশ সড়ক এখনও মাটির। যেগুলো আগের দুই মেয়রের সময়ে পাকা হয়েছিল, সেগুলোর অবস্থাও যাচ্ছেতাই।

বরিশাল নগরীর মূল কেন্দ্র থেকে কাউনিয়ার বিসিক শিল্পনগরীর দূরত্ব কিলোমিটার দুয়েক। বিসিক থেকে বাইপাস সড়ক গিয়ে মিশেছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে। ২০০৩ সালে মজিবর রহমান সারোয়ার মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় সড়কটি পাকা হয়। কিন্তু বর্তমানে সড়কটির কোনো অংশই আর অক্ষত নেই। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় পিচ ঢালাইয়ের নাম-নিশানাও নেই। সড়ক থেকে দুই পাশের মহল্লায় যেসব গলি ঢুকেছে, সেগুলো সবই মাটির। কয়েক দিন আগের বৃষ্টিতে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এই সড়কের দুই পাশে সিটি করপোরেশনের ৩ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ড।

এ দুই ওয়ার্ডের সীমানা এলাকা পশ্চিম মোতাশায় চায়ের দোকানে কথা হয় দোকানি মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ১০ বছরেও সড়ক সংস্কার হয়নি। শওকত হোসেন হিরন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এ এলাকায় পানির পাইপ আসে। এরপর আহসান হাবিব কামালের পর মেয়র সাদিক আবদুল্লাহও বিদায়ের পথে। কিন্তু পানি আসেনি। যাঁদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তাঁদের বাড়িতে সাবমার্সিবল মেশিনে পানি ওঠানো হয়। তা দিয়ে মেটে গরিব প্রতিবেশীর তৃষ্ণা। গোসল, ধোয়ামোছার পানির চাহিদা মেটাতে হয় খাল কিংবা পুকুরের পানিতে। সিটি করপোরেশনের খালের অবস্থাও খুবই খারাপ। পানি পচে গেছে। মাসে ২০০ টাকা বিল দেন, কিন্তু এলাকাবাসী পানি পান না। সিটি করপোরেশন শুধু সড়কবাতি দিয়েছে।

উন্নয়ন না হওয়ায় মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে একতরফা দায়ী করলেন ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল কালাম মোল্লা। তিনি বলেন, সড়ক নেই, পানি নেই, ড্রেন নেই; কিন্তু কর দিতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সব অভিযোগই সত্য। বর্তমান মেয়র সরকারের কাছ থেকে এক টাকাও আনতে পারেননি উন্নয়নের জন্য।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হলেও উন্নয়ন না হওয়ায় কাউন্সিলরদের দায় নেই বলে দাবি করেছেন আবুল কালাম মোল্লা। তিনি বলেছেন, কাউন্সিলর হিসেবে জন্ম-মৃত্যু, নাগরিকত্ব এবং উত্তরাধিকার সনদ সঠিকভাবে দিয়েছেন। সাদিক আবদুল্লাহ মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পর গত সাড়ে চার বছরে মাত্র পাঁচবার করপোরেশনের সাধারণ সভা হয়েছে। মাসিক সভাও হতো না। মেয়র করপোরেশনের কার্যালয়ে অফিস করতেন না। ফলে ওয়ার্ডগুলোর সমস্যা মেয়রকে জানানোর উপায় ছিল না।

কালাম মোল্লার দাবি, এলাকার সমস্যা জানানোর কারণে তাঁর ওপর হামলা করান মেয়র। মামলাও করা হয়েছে। যে কাউন্সিলরই ওয়ার্ডের দাবিদাওয়া মেয়রের কাছে তুলেছেন, তাঁর ওপর মামলা-হামলা হয়েছে। আবারও প্রার্থী হওয়া এই কাউন্সিলর বলেছেন, এবারও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তিনি।

বর্ধিত এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বক্তব্য জানতে পারা যায়নি। তিনি গত ৪ এপ্রিলের পর বরিশালে আসেননি। তাঁকে ফোন করে এবং বর্ধিত এলাকার বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সাদিক আবদুল্লাহর পরিবর্তে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। ভোটের মাঠে তিনিও বর্ধিত এলাকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, বর্ধিত এলাকায় কোনো উন্নয়নই হয়নি। সেখানে মানুষ অবহেলিত। পানি, রাস্তা, ড্রেন– কোনো অবকাঠামো নেই।

আরো পড়ুন : সাপাহারে চাঁদা দাবী, পুকুর খননে বাধা প্রদান ও মারপিটের ঘটনায় মামলা দায়ের

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *